
'আমার এ গল্প, যদিও স্বল্প,
তাতে কল্প - অতি অল্প!?!'
এক যে ছিল রাজা। রাজার ছিল ভারি (অ)সুখ! রাজা "সামান্য" একটু ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসেছেন! কিন্তু এদিকে রাজ্যের যত্তোসব (!) হেকিম আর কবরেজের (নি)(র)ভুল (!) রোগনির্ণয়ের খপ্পরে পড়ে এই "সামান্য" ঠান্ডা যক্ষার মত অসামান্য আকার ধারন করেছে!
আর তোমরা তো জানোই যে রাজার এই "সামান্য" ঠান্ডার চিকিৎসা কি - সাত দিন সাত রাত স্রেফ যদি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দাও কিংবা বড়জোর স্বপ্নে যমের সাথে মল্লযুদ্ধ খেলেই পার কর - তারপরও ঐ সাত দিনেই তোমার ঠান্ডা ছাড়বে! হেকিম আর কবরেজের দলের মুখ হাঁড়ি, যদি তারা "সামান্য" ঠান্ডাকে রাজার কাছে যক্ষা বলে চালিয়ে দেয় চালিয়াতের মত, তাতে কি দোষ দেয়া চলে!?
কত ঔষধ রাজাকে খাওয়ান হল, কিন্তু ঐদিন রাজার কোন ফল হল না। ফল একরমের হল, কিন্তু একটু ইতরবিশেষ! অত কিছিমের ঔষধ খেয়ে রাজার বাড়তি কিছু (আ)মদ্ জুটে গেল, পেট নেমে গেল আর একটু জ্বর এল! এদিকে রাজা (স্বেচ্ছায়) অসুস্থ হয়ে ছুটি নেবার কথা ভাবছিলেন - দেখলেন - এই তো সুযোগ! রাজা সিংহাসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে পড়ে সটান - একেবারে চিৎপটান্!
পরদিন সক্কাল একেবারে দশটায় রাজা উঠলেন - ষাঁড়ের মতন অসার হয়ে সারারাত নাক ডাকাডাকির পর! বললেন-
"আজ রাতের মধ্যে যদি আমার (সাধের) ঠান্ডার কোন গতিক না হয়, তবে হেকিম আর কবরেজকে শূলে চড়াব! হু! এই বলে রাখলাম!"
এমনি "হু!"র হুন্কার শুনে হেকিম আর কবরেজ কক্ষে এসে ভাবতে ভাবতেই তাদের মাথার চারপাশে যার যা ছিল...ভাবছ তো যে গবেষনাগারে গিয়ে ভেষজ লতা-পাতা নিয়ে মাথার ভিতরে চারপাশের গোবর নিয়ে পড়ল.. - হেঃ হেঃ আমি তাই ভাবছিলাম কিন্তু ওরা আসলে মেঝেতে পড়ে থাকা আদুরে মাদুরে গড়াগড়ি খেয়ে পড়ল- পড়েই দে ঘুম!
মহারাজা ষষ্ঠদিন দিবাগত রাতে খাট থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন..এমন সময় তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে মহাকাশ নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে - কোথায় যেন উড়ে - দেখলেন, এ কোন "দারুচিনি দ্বীপের দেশ"এ তিনি!
চারপাশে সব বেঁটে বামনের দল। তবে রাজার চুলের রঙ সোনালী - এসব দেখতে রাস্তায় ভীড় জমে গেল। কিন্তু রাজার পকেট, গড়ের মাঠ! তো একজন বলল - পশুপাখি পালনের মত কাজ জানা থাকলে তো ভাল আর না হলে সব বেঁচে-বুচে দিতে! বলল এখানে -
“পশুপাখি পালনই প্রধান কাজ,
আর বাকি সব বাখোয়াজ!”
এক নাপিতের কাছে গেলে রাজার চুল ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান, মাথা থেকে পরচুলা খসে এলো, তখন নাপিতটা গম্ভীরভাবে বলল-
"অন্যের পরচুলা ফেরিওয়ালার ব্যবসা কদ্দিন ধরেছ? ফেরিগিরি যখন করবেই, তখন দেখ তো, পরচুলাটা আবার ভেজা আর কেমন জট-পাকানো! এত লোকের পরচুলা থাকতে ফকিরের পরচুলা পড়ে কেনইবা ফেরিগিরি করছিলে?"
"জী? আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না!"
মুখে তো বলেন কিন্তু রাজার ততক্ষনে সাড় ফিরেছে, বুঝলেন ওটা গত ক'দিন রাজা-রাজড়ার আঁটো-সাঁটো পোষাক পরে শোওয়ার কারনে ঘেমে ভিজেছে আর ছ'দিন গোসল না করে জটা! রাজাকে দোকান থেকে তাড়িয়ে দিল নাপিত!
রাজা পাশেই দেখতে পান, এক দরবেশ বসে আছেন। আশ্চর্য! দরবেশকে ঠান্ডার কথা পাড়তেই বললেন-
"অসুখ সারাবার উপায় ভারী কঠিন, পারবি?"
"বিনে পয়সায় হয় তবে পারব!"
"শোন, আমার কথা শুনবি আর না শুনলে... শাস্তি...সবাই তোকে পাগল বলবে! তবে শোন যে দাওয়াই দেব তা সার্বজনীন, তবে তুই কি করবি তা আমি জানি! তাহলে এবার দাওয়াইটা - শপথ কর যে তুই প্রতিদিন অন্ততঃ একটা করে লবঙ্গ খাবি। তবে তোর মনের ঐ কালো জিনিসটা আমায় দিতে হবে!"
"কালো জিনিস?"
"আরে! তোর মনে যে কালো আত্নাটা - যেটা আজকে তোর সাথে আমার কথার প্রথম থেকেই আমার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি - ঐটে দিতে হবে..না হলে নড়তে পারবি না!"
এভাবে রাজার কাছে আস্তে আস্তে সব পরিস্কার হয় - রক্ত গরম হবার পরও তিনি নিশ্চুপ থাকেন। দরবেশই নীরবতা ভাঙ্গেন -
"তোর কলজেটাই চাইতাম কিন্তু সেটা তোদের মত নীচদের জন্মগতভাবে অনুপস্থিত! কেন আয়নায় দেখিসনি কখনও?"
শুনে রাজার প্রচন্ড রাগ হয়! আর থাকতে পারেন না তিনি! একটা বড়সড় পাথর তুলে নিয়ে মারলেন ওর দিকে। পাথরটা ওর বুকে বেকায়দায় লেগে মুখ দিয়ে রক্তের ধারা বইয়ে দিল! যে বুকে আর মুখে-মুখে এত কথা - দুটোই রাজা চিরতরে স্তব্ধ করে দিলেন একেবারে এক ঢিলে! দেখতে দেখতে অনেক লোকজন জড় হলো!
একথা সেকথায় সবাই কি বুঝল, রাজাকে দে পিটুনি! গনধোলাই হলে, তাকিয়ে দেখেন দরবেশের দেহ উধাও! রাজা উঠেই দিলেন চোঁচা-দৌড়! কিন্তু পথিমধ্যে পা হড়কে...
তারপরদিন রাজা বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তবে সে রাজা এ রাজার অনেক তফাত! শরীর আর্ধেক হয়ে গেছে ভুগে, ভোগানিতে বড্ড দূর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি, অনেক কষ্টে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান! একি! টানা ছ'দিন গোসল না করে রঙটা অনেক খোলতাই আর কালচে হয়েছে সন্দেহ নেই! আর জামাকাপড়ের যা ছিরি, তাকে ছিরি না বলে ছেঁড়াছিঁড়ি বলাই ভাল! সারা গায়ে ব্যথা আর কেটে ছড়ে যাওয়া মারের দাগ - একেবারে দগদগে! লম্বায় আর্ধেক হয়েছেন!
আর রাজার মনে পড়ে গেলো তার রাজ্যের সবাই লম্বা- তাদের মধ্যে হাঁটুর সমান হয়ে বেঁটের মত তাকে এখন হাঁটতে হবে।
সবশেষে বুকের মাঝামাঝিতে দেখেন যে জিনিসটা থাকে সবার - সেটা নেই! তাহলে কি...
তাড়াতাড়ি জামা নামিয়ে ফেলেন তিনি! তারপর রাজা হিসাব কষেন--
ঘড়িতে ভোর পাঁচটা - সবাই ঘুমিয়ে, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে তার এই নিস্কর্মা অথচ সুন্দর চেহারার লোকের দেশে 'পাগল' ছাড়া অন্য কোন পরিনতি যে তার নেই, বুঝতে দেরী হয় না তার!
সবার ঘুম ভাঙ্গলে যা হবার তাই হয়, দরবেশের কথা ফলে যায় - আর হ্যাঁ! শেষবার তুমি ভেবেছ কিন্তু ঠিক! কিছুই না, একটু ইতরবিশেষ! শুধু 'পাগলা' নাম কি আর (যুৎ)সই হয় - ও নামে তো আজ আমরা সবাইকে মাথার পেছনে আদর করে ডাকি - তাই যারা তাকে একটু বেশীই ভালবাসত, তারা তাকে আদর করে মাথার সামনেই 'পাগলা বাবা' নাম-এ ডাকা শুরু করল - ওদের দেশে জ্ঞানীদের এভাবে ডাকার রীতি!
আর যে রাজ্যের প্রজাদের কথা বলছি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দুনিয়ার সেরা বলে দাবী করতো - তাই "নতুন" রাজাকে নিয়ে বন্দনাগীতি রচনা করা সময়ের ব্যাপার ছিল! আমার দৃষ্টিতে গানটাকে একেবারে সাধারনমানের 'হ য ব র ল' মনে হলে কি হবে, ওরা তো রোজ সকালে তোপধ্বনি সহকারে - এ 'জাতীয় সঙ্গীত' বাজিয়ে আমার কানের পোকা বার করেই ক্ষান্ত হল না, একেবারে সূদূরপারের দেশ - যেখানে প্রতিভা নেই, অথচ গানকে পন্য আর (ষ্টেন)গান বানিয়ে ব্যবসার কারিগরী জারিজুরি চলে- সেখানে একেবারে "টপ চার্টে" নাকি "চার্টের টপে" চলে গেল! আর যেটা ঘটেছে - সেটা ভাবতেই কান এখনই আমার লালে-লাল হয়ে উঠছে, কিছুই না এ দেশের 'জাতীয় সঙ্গীত'ই আজ দুনিয়ার সব দেশের সর্বসম্মতিতে সব ভাষায় অনুদিত হয়ে সার্বজনীন 'জাতীয় সঙ্গীত'এ পরিনত হয়েছে!
আর যে (অ)বিখ্যাত গান নিয়ে এত মাতামাতি - স্হানস্বল্পতার জন্য এখানে প্রথম চার কলি উদ্ধৃত করলাম -
"কে গো 'পাগলা বাবা' এলে যে
এই যে মোদের ভুবনে,
নতুন নামে ডাকব (রাজাকে) আবার ,
মোরা জানি, মন জানে"!?!........
রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯