বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০০৯

অসীম দূরদর্শী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী



একটি ইংরেজী দৈনিকের অভিজ্ঞ এবং প্রধান সাংবাদিক সাইরাস তার গাড়ী থামালো বুড়ো হারুন সাহেবের গ্রাম্য খামার বাড়ীর সামনে। কিন্তু গাড়ী থেকে নামার পর বেশ কিছুটা অবাকই হল বলা যায়। সে চরম প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিযোগীতার যুগে কিছু লোকের ভীড় না হলেও গুটিকতক ছোটখাট বাংলা দৈনিক অথবা ম্যাগাজিন অথবা বড়জোর একটা বাঙালী ফোরাম ওয়েবসাইটের সাংবাদিককে আশা করেছিল। আশা করেছিল বললে ভুল হবে - টিপিক্যাল সাংবাদিক গোছের সে নয়, বরং সাংবাদিকদের সার্কেলে - তার মাথার পিছনে "অসামাজিক" বলে তার একটা দূর্নাম আছে! তারপরও হালকা শিস্ দিতে দিতে টিপিক্যাল প্রফেসনাল সাংবাদিকের মত তার পত্রিকার সম্পাদক তাকে যে "মিশন ইম্পসিবল" দিয়েছেন, তাতে সে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এবং উৎসাহকে ঢেলে দিল।

পুরনো বাড়ীখানার দিকে তাকল সাংবাদিক সাইরাস। বাড়ীটি শান্ত - নিস্তব্ধ - শান্তিপূর্ণ। সামনের বাগানে তার অপছন্দের কিন্তু মনের গহীনে সে স্বীকার করবে যে, বাড়ীর মালিকের লাগান দৃষ্টিনন্দন নয় অথচ পুষ্টিগুনে ভরপুর এমন শীতের সবজী যেমন - মূলা, মটর-শূঁটি, গাজর, ওল-কপি আর দূরে বাদাম মানে জাম্বুরা, বেল এসব গছের দৃশ্যে - তার দু'চোখ সবুজ দেখে - অনেকদিন পর জুড়িয়ে গেল। নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে সে উপরে উঠতে লাগল।
সাংবাদিককে দেখে হারুন সাহেব কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন -

--কাকে চাইছেন?

--জী, আমি সাইরাস। দেশের সবচেয়ে বড় ইংরেজী দৈনিকের প্রধান সাংবাদিক।

--বাবা তুমি কোন সংবাদপত্রের কথা বলছ?

সাইরাস সাংবাদপত্রের নামটা বলে। পরিস্কার বুঝতে পারে, বুড়ো কোনদিন ইংরেজী সাংবাদপত্র দূরে থাক,গোটা দুনিয়ার সংবাদের ব্যাপারে উদাসীন এবং স্বভাবতঃই বুড়োর নাম তার কাছে অজানা। তবুও সে মোটেই বিব্রত না হয়ে বলে-

--আমাদের পত্রিকা অফিসে কে বা কারা ফোন করে জানিয়েছে যে আপনাদের একমাত্র সন্তান মেধা নাকি অত্যন্ত মেধাবী - স্কুল-বিতর্ক এবং দাবায় সে দেশের জুনিয়র চ্যাম্পিয়নই নয়, বাঁশীতে সে দেশের জুনিয়র ও বড়দের প্রতিযোগীতায় দেশে-বিদেশে অনেক বিরল সম্মান বয়ে এনেছে। এমন প্রতিভাধর মেধাবী এদেশের ইতিহাসে বিরল - তবে আমাদের বিখ্যাত সাংবাদপত্রের এ নিউজ আইটেমটিতে যে বিষয়ে কনসার্ন তা হল...

এতটুকু বলে সাইরাস একটু দম্ নেয়। প্রায় দশ-বারো ঘন্টার জার্নিতে দেশের প্রত্যন্ত অন্ঞ্চলে এসে এমন বিশাল হাস্যকর বক্তৃতা এবং দীর্ঘ পঁচিশ বছর চাকরির পরও তার এ পজিশনে এসেও এতটা খাটুনি - দুটোই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। এতে যে শারিরিক-মানসিক কষ্ট - এত বছর চাকরির পরও - শুধু সম্পাদক সাহেবের সাথেই নয় মায় অফিসর পিয়নের সাথেও তার যে দৈনন্দিন মিস-কমিউনিকেশন - কেউ যে তাকে বুঝল না , কিইবা পেয়েছে জীবনে সে - না সুখ , না শান্তি , না পরিবার , না সমাজ - শারিরিকের চেয়ে যে মানসিক যন্ত্র-না - তা অনেক বেশী প্রকট হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। সে মনস্থির করে ফ্যালে - আজই সে সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠাবে - পদত্যাগের চিঠি! না! কোন ভাবাবেগ বা মানসিক চাঞ্চল্য যেমন - "সহকর্মীদের সাথে ভুল-বোঝাবুঝি বশতঃ" বা "পুরুষ সহকর্মীদের মাঝেও তাকে আলাদাভাবে সব ভুলের জন্য একপাক্ষিকভাবে বলির পাঁঠা বানান" এমন ঠুনকো অথচ মোক্ষম ছুতা সে চিঠিতে পদত্যাগের কারন হিসেবে দেখাবে না! সে আজকালকার অতি উচ্চপদস্থ কর্পোরেট এক্সিকিউটিভদের স্বকপোলকল্পিত 'স্বেচ্ছায় আমোদ-প্রমোদ সম্ভোগের ছুটি'র জন্য - ফস্ করে লেখা কল্পিত "লিভ অব এ্যাবসেন্স" এর মত ফরমাল লেটারে দেয়া "পারিবারিক বা ব্যক্তিগত" কারনের মত মধুর ভুল - কারন হিসেবে দেখাবে! যদিও ঘটনাচক্রে, তার পরিবার থেকেও সে পরিবারহীন! তাই "ওস্তাদের মার শেষ রাতে"র মত ক্যারিয়ারের বা হয়তঃ জীবনের এই শেষ ছুটি নেয়াটা সে সবচেয়ে কূটনৈতিকভাবে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়!

মোটা মাইনাস পাওয়ারের চশমার ভিতর থেকে দুটো কৌতুহলী চোখে চোখ পড়ে সাইরাসের।

--জী বাবা, যা বলার তাড়াতাড়ি শেষ করুন, কারন আমাদের হাতে সময় খুবই কম। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই মেধাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা রওনা হচ্ছি তো, তাই!

কন্ঠটা যথাসম্ভব কাঁদো-কাঁদো - যেন শোকবার্তা পাঠ করছে এমনভাবে বলে-

--জী, আমি সেই ব্যাপারেই সংবাদসংগ্রহের জন্য এসেছি। "মেধা-বিকাশের জন্য কনসার্ট" - যা আমাদের বিশিষ্ট সংবাদপত্র আয়োজন করেছে - যাতে সংগীত পরিবেশন করেছেন - বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী কাঙালিনী (!) সোনাই বিবি - যদিও আমরা পাশের দেশের সঙ্গীতশিল্পী বালু সাগু যার নিক্ নেম বাল্লু সাল্লু - তাকে অল্পের জন্য মিস্ করেছি -যা আমাদের সামগ্রিক ইনডাসট্রির জন্য বিশাল ক্ষতি আর সবচেয়ে বড় কথা হল - যাতে আরো অনেক বেশী টাকা আসত - তবে এতকিছুর পরও কনসার্ট শতভাগ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে! কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে
কনসার্ট থেকে আশানুরূপ টাকা ওঠেনি! তাই সম্পাদক সাহেব বললেন যে আবার বাল্লু সাল্লুর কনসার্ট হবে, আমাকে মেধার ব্যাপারে একটা রিপোর্ট বানাতে এখানে পাঠালেন।

--ও...!আচ্ছা...!আচ্ছা...!...কিন্তু সময় যে বড়ই কম! আমার মা মেধার চিকিৎসার জন্য এ মূহূর্তে না হলেও আজকের মধ্যে বেশ কিছু টাকা চাই। টাকার ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন?

--ওহ্ হো হো!...আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে আমাদের পত্রিকার 'সাহায্যের আবেদন' বিজ্ঞাপনেই তো ছিল যে মেধার মাথার সমস্যা! না মানে...ব্রেন টিউমার হয়েছে, তাই না?

অর্থনৈতিক ব্যাপারটা নিরর্থক টেনে না নিয়ে আসার জন্য হারুন সাহেবের নির্দোষ বাউন্সার থেকে সাইরাসের ব্যর্থ (ক্রিকেটের ভাষায় যাকে বলে) ডাক্ মারা!

--জী...হ্যাঁ! কিন্তু কোন টাকা কি সঙ্গে করে এনেছেন?

--আংকেল, আপনি একদম ভাববেন না, টাকা তো ক্যাশে আনা যেত না, তাই বিজ্ঞাপনে দেয়া ব্যাংকের একাউন্টে টাকা এতক্ষনে নিশ্চয়ই পৌছে গ্যাছে। টাকা কি তুলেছেন?

--দূর ছাই! পেলে কি আর এতবার জিজ্ঞেস করতাম তোমাকে? আমি আগেই এসব আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া এ আর কি হতে পারে? ঐ ব্যাংকের এ্যাকউন্ট তো ঢাকায় - আবার আমার এক আত্নীয়র নামে - সে টাকা আজ তো আর পাওয়া যাবে না! যাহোক...আমার আর কি ক্ষতি হবে বল? বললাম না আগেই আমি টের পেয়ে সবকিছু - মানে বাড়ি-ঘর, জমি-জাতি বন্ধক রেখে টাকা আর মেধাকে নিয়ে এখান থেকে চিরতরে চলে যাচ্ছি! আর তুমি নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপনে দেখনি যে - আমার মেয়েটি অটিষ্টিক!

--তাই নাকি?!

-যদিও আমার দৃষ্টিতে সে বুদ্ধিমতি,দূরদর্শী আর তোমাদের মত সবার দৃষ্টিতে আমার মেয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী! এখন পর্যন্ত আমার মেয়ে আমার চেহারা নয়- শুধু আমার কাজের প্রতিচ্ছবি হয়েছে, আমার দূরদর্শীতার মত গুন সে এ বয়সেই রপ্ত করতে পেরেছে-তাই আমি জানি সে আর কোনদিন এ'দেশে ফিরবে না তার ঐ গুনটি থাকার কারনে!
তবে জন্মগতভাবে সে এমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিল না, ছোটবেলায় ওর মার সাথে ও একবার এয়ারপোর্ট থেকে সিএনজীতে করে আসছিল, পথিমধ্যে কোন কারন ছাড়াই/এতে কারও কোনও হাত না থাকার পরও সিএনজীর সিলিন্ডারের বিস্ফোরনে ওর মা আর গাড়ীচালক ঘটনাস্থলেই মারা যায়!

--বলেন কি?

--হ্যাঁ...! আর আমার মেধা মা সৌভাগ্যবশতঃ ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে যায় ঠিকই কিন্তু তোমাদের মত সবার দৃষ্টিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে থেকে মরে থাকার মত অনেকটা!

সাইরাস বুঝতে পারে কথার প্রসঙ্গটা ক্রমশই অস্বস্তির দিকে যাচ্ছে! হারুন সাহেব বলতে থাকেন-

--যাহোক আমি বরাবরই এ বাণীটা জানি "একটা কলম সবসময়ই একটা তরবারির মত ভোঁতা"! তাই বলছিলাম কি যে, সংবাদপত্রের সামান্য এক পাতার অংশবিশেষে আমার মেধা মার সমস্ত মেধার ব্যাপকতা, গভীরতা এবং কোয়ালিটি - যে দিক দিয়েই দেখ - তা কুলোবে না! আর তোমার সঙ্গে এতক্ষন কথা কয়ে - তোমার সম্বন্ধে যা বুঝলাম - তা তুমি যে কেন তোমার বিশিষ্ট পত্রিকার প্রধান এবং সুযোগ্য রিপ্রেসেনটেটিভ তা বুঝতে আর বাকী নেই আমার! ( ভদ্রলোকের দম্ভোক্তি! )

সাইরাস বুঝতে পারে এরপর আর কোন কথা চলে না! আর কিইবা বলার আছে? সে ঘুরে দাঁড়ায়! ভাঙ্গা সিঁড়ি বেয়ে মোহগ্রস্তের মত নীচে নেমে এসে গাড়ীতে ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হয়!


রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯

কোন মন্তব্য নেই: