.jpg)
ঘড়ি আবিষ্কারের আগে নিশ্চয়ই মানুষ অনেক কিছুই জানতো না। এই যেমন- কোন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে দেরী শেষ করে পরে নানান ছুতায় তার ওপরওয়ালার কাছে ঢাকবার মিথ্যা চেষ্টা। এ দুয়ের যে সম্পর্ক আছে তা জানতে গেলে এ গপ্পো আপনাকে পড়তে হবে -
তখন প্রথম ঘড়ি আবিষ্কারের সময় । সময়টা যে কখন তা ইতিহাসের পাতায় দেখে নিলেই চলবে।
এক ছিল সৎ লোক- যার নাম ছিল ফাহমি। মানুষ হিসেবে তাকে ভালই বলা যায়। দর্শন এবং ইতিহাসে তার ছিল পারদর্শিতা-যুক্তিবাদী এবং বাইরের বিষয়ে জ্ঞান ছিল বিস্তর। প্রচুর পড়াশুনা করত-কথা বলত কম - সবকিছুর পেছনে শুধু যুক্তি খুঁজে বেড়াত। সে আত্নমগ্ন, অনেকটা শিশুসুলভ ছিল। পরিচ্ছন্ন মাপা জীবন এবং প্রকৃতিও বড় শান্ত। প্রত্যেকদিনের জীবন ছিল নিয়মকানুনে বাঁধা।
ফাহমি পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষা নিয়ে ঠেলে ডিগ্রী নেয়ার পক্ষপাতী নয় কিন্তু ভবিষ্যত কাজের খাতিরে, আসলেই ও মাথা থেকে যেসব বিষয়কে পরমজ্ঞান বলে মনে করে সে সব বিষয়ে তার এতো জ্ঞান,তা এত গভীর যে, তা প্রায় অননুকরনীয়। সারাজীবন সাধনা আর পরিশ্রম বলে নিজেকে দুনিয়ার অধিকাংশ দরকারী বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ করে গড়ে তুলেছে সে । সাধারন খেয়ালের বশে কিংবা পাবলিককে তাক লাগানোর ছলে জ্ঞানকে সে সমৃদ্ধ করেনি।
তারপরও "দুনিয়ার কোন কিছুই খুঁতবিহীন নয়!" এরকম প্রাকৃতিক নিয়মে তার অজ্ঞানতার বহরটাও ব্যাপক এবং আশা-জাগানিয়া বটে! এই যেমন - সমসাময়িক রাজনীতির কোন খবরই সে রাখে না! শুধু রাজনৈতিকই নয়,ধর্মীয়,সামাজিক অধিকাংশ বিষয়েই তার অজ্ঞানতা আঁতকে উঠবার মত। তবে তার নিজের এই অজ্ঞানতা বিষয়ে তার যে জবাবদিহিতা বা যুক্তি তা অকাট্য-
-"আমাদের মাথাটা একটা খালি বাক্সের মত! যারা বুদ্ধিমান তারা শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সেখানে ভরিয়ে রাখে কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, তারা কোন অপ্রয়োজনীয় তথ্য ঢুকতে দেয় না আর ভুলক্রমে বাক্সে ঢুকে পড়লেও তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা তাদের মাথায় থাকে! আর বোকার দলই যা-দরকার-নেই তা আশেপাশে মানে অন্যের মাথা থেকে কিংবা লাইব্রেরী বা বড়জোর মণিষীর বানী দিয়ে জোর করে ঠেসে সবসময় ভর্তি করে রাখে!"
সেই ফাহমি তার অফিসে একমাত্র লোক ছিল যে প্রতিদিন অফিস শুরু হবার অনেক আগে অফিসে গিয়ে বসে থাকত আর স্বভাবতই অন্য সহকর্মীদের হাস্যাস্পদ হত!
যাহোক,আমাদের গপ্পোর খাতিরে, সেই একই শহরে আরেক লোক ছিল-যার নাম ছিল হাজেম। মানুষ হিসেবে তাকে মোটেই ভালই বলা যায়না। যুক্তিহীন এবং বাইরের বিষয়ে ছিল অজ্ঞান। কোনদিন কোন পড়াশুনাও করেনি-ভয়ানক বেশী কথা বলে। অপরিমিত জীবন এবং প্রকৃতিও বড় অশান্ত ছিল। প্রত্যেকদিনের জীবন ছিল অনিয়মতান্ত্রিক। কিন্তু তার কেউ ছিল না। বাবা-মার মৃত্যুর পরও হাজেম কোন কাজকর্ম করত না, শুধু বসে বসে সব সম্পত্তি ভোগ করতো। মুখে তার ছিল মিষ্টি কথা। কিন্তু যখন সে বয়সে তরুণ হল, তখন একমাত্র ফাহমি ছাড়া তার সব বন্ধুরা তাকে ছেড়ে গেল। সে ছিল মূর্খ কিন্ত ধূর্ত,যদিও দুনিয়ার কোন খবরই সে রাখত না। সে যে খুব কাজের লোক ছিল তাও বলা যায় না। হাজেম জাঁকজমক পোষাক পরিচ্ছদে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালত কিন্ত দানের বেলায় সে হাত খোলার পাত্র নয়!অবশ্য যেদিন যা হাতে থাকে, সেদিনই তা শুধুমাত্র নিজের জন্য খরচ করে ফেলে,একটা পয়সাও হাতে রাখে না!কিন্ত এত কিছুর পরও ফাহমি আর হাজেমের ভারী ভাব!
স্বভাবতই দুনিয়ার প্রথম ঘড়ি আবিষ্কারের পর, দুনিয়ার অন্যতম প্রধান ধনী হাজেমই হল দুনিয়ার অন্যতম প্রথম ঘড়ি ব্যবহারকারী। ঘড়ি ব্যবহার করে সে যে সুফল কিংবা কুফল পেল তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে, সে গায়ে পড়ে ফাহমিকেও তখনকার দিনের প্রেক্ষাপটে একটা কমদামী ঘড়িকে "অনেক বেশী দামী ঘড়ি" বলে চালিয়ে দিল।
এদিকে ফাহমি ঘড়ি নিয়ে মনের সুখে বাসায় ফিরল। তার জীবদ্দশায় হয়তঃ কোনদিনই একটা ঘড়ি কেনার সামর্থ্য হত না তার,ভাবল সে! এদিকে ঘড়ির সময়ের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে তার দেহঘড়ির অভ্যাসে কিছু পরিবর্তন এলো! জীবনে যে সময় এত বেশী, তখন আবার সবে বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ আবিস্কার হবার আগে সে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যেত। এখন এ দুই বিলাস-ব্যসন আসাতে তার দিনে ও রাতের জীবনে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। কিছুই না, শুধু সন্ধ্যায় হাজেম তাস আর নানারকম আড্ডাবাজির খেলার প্রচলন শুরু করল এবং এভাবে প্রতিদিন ফাহমির শুতে শুতে সামান্য কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা দেরী হতে লাগল।
আর এভাবেই প্রতিদিন সকালে সে অবসাদগ্রস্ত হয়ে দেরী করে উঠতে লাগল এবং স্বভাবতই এই (!) সামান্য কয়েক মিনিট দেরী করে অফিস যাওয়া শুরু করল। তার অনেক বছরের স্বভাবের এই আকস্মিক-আমূল পরিবর্তনে অফিসের সহকর্মী, বস্ থেকে শুরু করে এমনকি পিয়নও বেশ বিচলিত হল এবং স্বভাবতই তাকে নিজেরা সারা জীবনেও মানেনি এমন সব উপদেশ দিতে লাগল! সহকর্মীদের এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী দেখে এবং তাদের কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে, কোম্পানীর মালিক শেষে একদিন আর থাকতে না পেরে ফাহমিকে ডেকে পাঠালো। কোম্পানীর মালিকের কাছে অবশ্য ফাহমি প্রথমদিন ছুতা দেখালো -
"স্যার, নতুন ঘড়ি উপহার পেয়েছি তো, যদিও সময়টা একদম ঠিক দেয় না, আর ঘড়িটা যাচ্ছে তাই রকমের ধীরে চলে, বুঝলেন!"
এরকম যা-ইচ্ছে-তাই মার্কা একটা অযৌক্তিক কথা বলে সেদিনকার মত সেখান থেকে সটকে পড়ে! এভাবেই দিন গড়াতে লাগলো। এদিকে ঘড়ির প্রযুক্তির উন্নতি হয়ে ডিজিটাল ঘড়ির প্রচলন হলো, যা কিনা মিলিসেকেন্ডও সঠিক সময় দেয়।
তারপরও কিন্তু, সেই যে আমাদের ভাল লোক গপ্পের ফাহমি বাস্তবের জীবনে আজও টিকে আছে! কেন তোমার চারপাশে তাকাও দেখবে, কিন্ত কাউকে আবার জোর-জবরদস্তি করে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেও না যেন,হয় সে মিথ্যা বলবে যেটা আজকাল খুব নাকি চালু ব্যাপার, না হয় গপ্পের পরিবর্তিত,দ্বিতীয় জীবনের ফাহমির মতো- যে হয়ত আজকের তোমার আমার মত অতো সহজ সাবলীল অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে না,কিন্তু সে ফাহমিও গপ্পের বদৌলতে একটু আধটু সবে ছুতো দেখাতে শিখেছে, তেমনি ছুতো দেখিয়ে সে তোমার সামনে থেকে কেটে পড়বে!
রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন