
তো এটা আমাদের সপ্তম প্রযোজনা। চিত্রায়নের জন্য লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছি সুখপুর গ্রামকে। সামনেই একটা ছোটখাট খালের মত - হয়তঃ তিতাসেরই একটা শাখা-টাখা হবে! দর্শক বলতে - সুখপুর গ্রামবাসী - স্বভাবতঃই যাদের মূল নাটকের চেয়ে নাটকের কলাকুশলী এবং অনেকটা গায়ে পড়ে কৌতুহল দেখানোর প্রবনতা বেশী! আজ যে অংশ চিত্রায়িত হবে তার জন্য মূল শূটিংস্পটে সরাসরি যাই চলুন:
একটা নৌকা - তার ওপর একটা খাটিয়া আড়াআড়িভাবে শোয়ান। খাটিয়াটা সবুজ। ওতে শুয়ে আছে গর্ভবতী প্রিয়াংকা। ও গর্ভবতী হওয়াতে ছবির কাহিনীর বরং কিছুটা সুবিধেই হয়েছে! আর বাকী ক'জন সব নৌকায়।
নৌকা চলেছে রূপপুরের দিকে। ছবিতে দেখাতে চাওয়া হয়েছে - একটি দল - যাদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাদের একজনের স্ত্রী গর্ভবতী। সেজন্য তাকে একটা খাটিয়ায় শুইয়ে কাফনের কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! কোথায় গন্তব্য - জানেনা কেউই। প্রত্যেকের মুখে উৎকন্ঠা। এরসাথে আবার যোগ হয়েছে গুজব না কি সত্যি যে একটা কথা মুখে মুখে ফিরছে - পাশের গ্রাম রাজাকারদের ডিপো!
মাঝির নাম - বদর! বৃষ্টির দরকার ছিল না - তারপরও কিছুক্ষণ হল শুরু হয়েছে! বীরূভাইকে স্বভাবতঃই গম্ভীর দেখাচ্ছে। বাইরের গুমোট ভাবটা যেন ভর করেছে ওর চোখেমুখে! কিছু না বলে একটা 'আগরবাতি' (!) ধরাল! বুঝলাম, আস্তে আস্তে ও উত্তপ্ত হচ্ছে - ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা বাড়ছে ওর! কে যে কথা শুরু করব বুঝতে পারছি না - হঠাৎ ও বলল -
:৭১'এ সেই যুদ্ধটার কথা মনে আছে তোর?
:কোনটা?
:ফুলছড়ির ১১ নং সেক্টরের সেই যুদ্ধটা?
:হু! বেশ মনে আছে!
আবার চুপ! বুঝলাম, আরো ভাবছে ও! আর এদিকে আমি ভাবছি - দূর ছাই! আসল চিত্রনাট্য কখন পাঠ করব! প্রথমে বীরুভাইয়ের সংলাপ থাকলেও তখন থেকে নষ্টালজিয়ার নষ্টামিতে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও! 'অন্তরালের কারিগর' - কবি এই সেদিনও বীরুভাইকে বাদ দেবার কথা বলছিল! তবে ও ছাড়া অনেকেই জানে যে বীরুভাইই সেরা - কারন ওর কাছে কবি ছাড়া দলের অনেকের হাতেখড়ি - এখনও ওর কাছ থেকে শিখছি আমরা! এইয যাহ্! ধ্যান ভেঙ্গেছে গুরুর:
: নাও শুরু কর তোমরা!
:আরে আপনিই তো পথ বাতলাচ্ছেন না গুরু!
:এই প্রিয়াংকাকে নিয়ে হয়েছে যত সমস্যা! না পারি রাখতে - না পারি ফেলতে! সেদিনও ছোট্টটি ছিল - দেখা হলেই 'বীরূভাই' বলে গগনবিদারী ডাক দিত আর আমিও নির্বোধের মত অদ্ভুত এক মায়ায় ওর কাছে ছুটে যেতাম!
:তো সমস্যাটা কোথায়?
:সমস্যাতো ওখানেই! বারবার ফিরে যাওয়াটায় কাল হয়েছে! ঐ মায়াই শেষে দায়িত্বে বর্তাবে কে জানত! ওর বাবাটা গেল চল্লিশে - যক্ষায় - ধূমপান আর এ্যালকোহলের সৎ-স্ত্রীর সঙ্গে মিলে আগেই আসল স্ত্রীকে বিদেয় করেছে! অভিভাবকত্বের সংজ্ঞাটা হয়তঃ ওর কাছে উল্টো ছিল - সারাজীবন ভুগে ভুগে সবাইকে কৌশলে ভুগিয়ে সমস্ত সেবা আর মমতার শেষ রসটুকু নিংড়ে নিয়ে শেষে অসময়ে পরপারে গিয়ে একপাক্ষিকভাবে জয়ী হওয়া! তাই হয়তঃ কোন অস্পষ্ট ইঙ্গিতে মেয়েকে সঁপে দিয়ে গেল!
:হু!
:ছোড়্ দো! কুছ পরোয়া নেহি! খাদ্যের মজুদ কেমন বল তো? এ সপ্তাহ চলবে তো?
:মৃণাল?! কোথায় তুমি?
সে দিনই আবার বিশ্ব খাদ্য দিবস ছিল! আর ভাবছিলাম যে - স্বভাবতঃ সেদিন সবাই একটু বেশী বেশী খাচ্ছে -কারন 'বিশ্ব খাদ্য দিবসে'র মূলমন্ত্র হল - 'যারা বেশী খাচ্ছে তাদেরই বানানো পুরস্কারপ্রাপ্ত আবিস্কার 'কৃত্রিম দূর্ভিক্ষ'এর গিনিপিগ মানে এই আমাদের মত যারা অতটা খেতে পাই না - তাদের মধ্যে যারা ওদের চোখে 'হেরে গিয়ে' মরে যায় মানে ভাগ্যবান - তাদের জন্য 'প্রতীকি' ভুরিভোজ করে সারাদিন নাক ডাকিয়ে - ''নীরবতা" পালন করাই হচ্ছে খাদকশ্রেণীর নৈতিক দায়িত্ব! তাই সবচেয়ে কূটনৈতিকভাবে উপভোগ করে খাদ্যের ব্যাপারটা নিরর্থক টেনে না নিয়ে আসার জন্য বীরূভাইর বাউন্সার থেকে আমার ডাক্ মেরে (খাবারের) আম্পায়ার মানে মৃণালের দিকে দৃষ্টিআকর্ষণ করা! আগেই বলেছি - খেতে পাই না তাই মৃণালের কথাও একই:
:আজ দুপুরে উপোস দিতে হবে!
:খুউব হল! তবে এতদিন কি খেয়ে ছিলাম? আহামরি কিছু? ঐ রুটি যা খেতে পাই তা দিয়ে জুতো বানানো যায়!
ছোড়্ দো! কুছ পরোয়া নেহি! ও মাঝি! রূপপূর কতদূর?
: একদম্ চুপ মারি যান্! কিডা জানি আসতিছে সামনে থিকা!
: মৃণাল তোর স্টেনগানটা রেডী কর আর ঐ কুম্ভকর্ণগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে বল্ 'ইন্নালিল্লা' পড়ার সময় পাবেনা বোধ হয়!
:কেডা যায়?
:আগে কও তুমরা কেডা?
তখনও ইতস্ততঃ বোধ করছি। পরিচয় দিলে যদি কিছু ঘটে যায়! তবু সাহস করে মাঝি বলল
: মুক্তিযুদ্ধারা যাইতিছে গো!
ও নৌকায় এতক্ষনে সাড়া পড়ল-
: আল্লার নাম লইয়া যানগো সুনারা! আমরা যামু সুখপুরে!
: ছাছামিয়া দোয়া রাইখেন!
কিন্তু দোয়া রাখবার তখন সময় কই?
আপাততঃ এটুকুর চিত্রায়ন হয়। বাকীটুকু বিকেলে হবে। একটু গা এলিয়ে দিতে যাব এমন সময় আবার শুরু হল গুরুর গুড় গুড় ধ্বনি-
: আচ্ছা, বিকেলেই তো শেষ অংশের চিত্রায়ন হবে। তারপর ইউনিট প্যাকআপ - শুটিং বনধ! আমরা আবার যে যার জায়গায়!
:হুম্! তাই তো?
: একটা সিনেমা - মানে দর্শকের প্রশংসা আর হাততালি আদায় করার মত কিছু কথা জোড়াতালি দিয়ে মারা - এভাবেই তো সব শেষ, তাই না? কিন্তু এতে কতটুকু মুক্তিযুদ্ধকে আনতে পারছ ফ্রেমে? এরকম অসহায় পরিবার হয়তঃ ছিল সেসময় কিন্তু তাতে ট্রাজেডি কিংবা টুইষ্ট ফুটিয়ে তুলতে পারছ কই? তাই তোমার আগের বানানো অধিকাংশ ব্যবসাতে অসফল ছবিকে শুধু আমার এ্যাকটিং দিয়ে টেনে তোলার মত এ যাত্রায়ও ঠিক করেছি বিকেলে কিছু দেখাব?
:কিরকম?
:ও তুমি বুঝবে না! আসল এ্যাকটিং মুখের ভাষায় প্রকাশের বিদ্যা নয়! তারপরও বলি - অস্তিত্বের সংকট আবার জীবনবোধ এইসব আর কি!
আবার শুটিং শুরুর তোড়জোড় -একঘেঁয়ে! এবারের সিকোয়েন্সটা হবে এরকম - ভাবতে হবে কতগুলো গানবোট আসছে
এবং সংক্ষেপে মানে খুব বেশী না ক্ষেপে আমাদের অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে হবে!
:রূপপূর পেরায়ই আসি গিচে!
:বীরুভাই! ও বীরুভাই! ঘুমুলেন নাকি!
:উঃ?!
:এখন আবার কি হল? উঠুন উঠুন! কখন যে ঐ সাচ্চা মোল্লার দল চলে আসবে - জানি না!
:ঠিকই! কেউ আসছে বোধহয়! আমি আওয়াজ পেয়েছি!
:জাগো বাহে! আমাগো মোল্লা ভাইগো বুলেট দিয়া খিলাইনোর সুময় হইচে!
সত্যিই গানবোট আসছে! একটার পর একটা! আমি নিথর! একটু শব্দ হলেই ওরা টের পাবে! হঠাৎই এরমধ্যে বীরুভাই এর গলার স্বরে পরিবর্তন - বাঁজখাই গলায় তার চিৎকার -
: সবাই একদম চুপ! আজরাঈল আসছে!
কিন্তু আমি ভাবছি অন্যকথা! সিকোয়েন্সটা তো আসলে এমন হবার কথা ছিল না! সব কেন যেন গোলমেলে ঠেকছে!
আমার আশ্চর্য হবার ভাবটা আর সবার মধ্যেও যেন সংক্রামিত হচ্ছে!
এরপর...আমরা যেন প্রথম আলো দেখলাম! কিন্তু এ আলোতে আমরা এ কি দেখলাম?! অতিমানবীয় কিছু! 'আসল এ্যাকটিং মুখের ভাষায় প্রকাশের বিদ্যা নয়'র মত বর্ণনাতীত অপ্রকাশ্য...হ্যাঁ...তবুও আমি যেটুকু বুঝছি সেটুকু লিখে যাচ্ছি...হায়েনার লাল চোখ...কিশোরীর বাঁশবনে ছোটাছুটি...ইয়াহিয়ার সেই ভয়ন্কর পোষ্টারের ফাঁকা ময়দানে আগুনে ঝলসে যাওয়া...আর ব্যাকগ্রাউন্ডে মানে সবকিছুর মূলে কিংবা গল্পের প্রথমে বলা সেই 'ধন্যবাদহীন - অন্তরালের কারিগর'এর মত - সেই 'অনেক শীত আর একটি বসন্ত' এর মত - সেই গনগনে টকটকে আমাদের সবার কাম্য - একটি লাল সূর্য! এ যেন পুরো মুক্তিযুদ্ধকে দেখলাম এ আলোতে!
চরিত্র পরিচিতি:
আমি: পরিচিতির শুরুতেই এক চিমটি গসিপ বা স্পেকুলেষন - এ আমার রচনা নয়! মূল চিত্রনাট্যের খসড়াটা পাই একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে যে আজ অগোচরে হারিয়ে গেছে বা সেরকমই ভাবতে বা গুজব রটাতে আমি পছন্দ করি যাতে সিনেমা শুরুর সময় আমার নামটা দেখিয়ে (ইতি)-হাঁসে স্থান করে নেয়!
বীরু ওরফে 'বীরুভাই': সিনেমাতে আসা বলতে আমিই নিয়ে এসেছি তাকে! তবে তাকে প্রধান চরিত্র দেয়াটা - কিছুটা সিনেমার স্ক্রীপ্টের জন্য আর পুরোটাই তার মত ভারসাম্যহীনকে (!) ঠান্ডা রেখে কাজ হাসিল করার একটা পাঁয়তারা বা ষড়যণ্ত্র!
রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন