বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০০৯

দারুচিনি দ্বীপের দেশে প্রথম (অ)মানুষ




'আমার এ গল্প, যদিও স্বল্প,
তাতে কল্প - অতি অল্প!?!'

এক যে ছিল রাজা। রাজার ছিল ভারি (অ)সুখ! রাজা "সামান্য" একটু ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসেছেন! কিন্তু এদিকে রাজ্যের যত্তোসব (!) হেকিম আর কবরেজের (নি)(র)ভুল (!) রোগনির্ণয়ের খপ্পরে পড়ে এই "সামান্য" ঠান্ডা যক্ষার মত অসামান্য আকার ধারন করেছে!

আর তোমরা তো জানোই যে রাজার এই "সামান্য" ঠান্ডার চিকিৎসা কি - সাত দিন সাত রাত স্রেফ যদি ঘুমিয়েই কাটিয়ে দাও কিংবা বড়জোর স্বপ্নে যমের সাথে মল্লযুদ্ধ খেলেই পার কর - তারপরও ঐ সাত দিনেই তোমার ঠান্ডা ছাড়বে! হেকিম আর কবরেজের দলের মুখ হাঁড়ি, যদি তারা "সামান্য" ঠান্ডাকে রাজার কাছে যক্ষা বলে চালিয়ে দেয় চালিয়াতের মত, তাতে কি দোষ দেয়া চলে!?

কত ঔষধ রাজাকে খাওয়ান হল, কিন্তু ঐদিন রাজার কোন ফল হল না। ফল একরমের হল, কিন্তু একটু ইতরবিশেষ! অত কিছিমের ঔষধ খেয়ে রাজার বাড়তি কিছু (আ)মদ্ জুটে গেল, পেট নেমে গেল আর একটু জ্বর এল! এদিকে রাজা (স্বেচ্ছায়) অসুস্থ হয়ে ছুটি নেবার কথা ভাবছিলেন - দেখলেন - এই তো সুযোগ! রাজা সিংহাসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে পড়ে সটান - একেবারে চিৎপটান্!

পরদিন সক্কাল একেবারে দশটায় রাজা উঠলেন - ষাঁড়ের মতন অসার হয়ে সারারাত নাক ডাকাডাকির পর! বললেন-

"আজ রাতের মধ্যে যদি আমার (সাধের) ঠান্ডার কোন গতিক না হয়, তবে হেকিম আর কবরেজকে শূলে চড়াব! হু! এই বলে রাখলাম!"
এমনি "হু!"র হুন্কার শুনে হেকিম আর কবরেজ কক্ষে এসে ভাবতে ভাবতেই তাদের মাথার চারপাশে যার যা ছিল...ভাবছ তো যে গবেষনাগারে গিয়ে ভেষজ লতা-পাতা নিয়ে মাথার ভিতরে চারপাশের গোবর নিয়ে পড়ল.. - হেঃ হেঃ আমি তাই ভাবছিলাম কিন্তু ওরা আসলে মেঝেতে পড়ে থাকা আদুরে মাদুরে গড়াগড়ি খেয়ে পড়ল- পড়েই দে ঘুম!

মহারাজা ষষ্ঠদিন দিবাগত রাতে খাট থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন..এমন সময় তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে মহাকাশ নক্ষত্রের মধ্য দিয়ে - কোথায় যেন উড়ে - দেখলেন, এ কোন "দারুচিনি দ্বীপের দেশ"এ তিনি!

চারপাশে সব বেঁটে বামনের দল। তবে রাজার চুলের রঙ সোনালী - এসব দেখতে রাস্তায় ভীড় জমে গেল। কিন্তু রাজার পকেট, গড়ের মাঠ! তো একজন বলল - পশুপাখি পালনের মত কাজ জানা থাকলে তো ভাল আর না হলে সব বেঁচে-বুচে দিতে! বলল এখানে -

“পশুপাখি পালনই প্রধান কাজ,
আর বাকি সব বাখোয়াজ!”

এক নাপিতের কাছে গেলে রাজার চুল ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান, মাথা থেকে পরচুলা খসে এলো, তখন নাপিতটা গম্ভীরভাবে বলল-

"অন্যের পরচুলা ফেরিওয়ালার ব্যবসা কদ্দিন ধরেছ? ফেরিগিরি যখন করবেই, তখন দেখ তো, পরচুলাটা আবার ভেজা আর কেমন জট-পাকানো! এত লোকের পরচুলা থাকতে ফকিরের পরচুলা পড়ে কেনইবা ফেরিগিরি করছিলে?"

"জী? আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না!"

মুখে তো বলেন কিন্তু রাজার ততক্ষনে সাড় ফিরেছে, বুঝলেন ওটা গত ক'দিন রাজা-রাজড়ার আঁটো-সাঁটো পোষাক পরে শোওয়ার কারনে ঘেমে ভিজেছে আর ছ'দিন গোসল না করে জটা! রাজাকে দোকান থেকে তাড়িয়ে দিল নাপিত!

রাজা পাশেই দেখতে পান, এক দরবেশ বসে আছেন। আশ্চর্য! দরবেশকে ঠান্ডার কথা পাড়তেই বললেন-

"অসুখ সারাবার উপায় ভারী কঠিন, পারবি?"

"বিনে পয়সায় হয় তবে পারব!"

"শোন, আমার কথা শুনবি আর না শুনলে... শাস্তি...সবাই তোকে পাগল বলবে! তবে শোন যে দাওয়াই দেব তা সার্বজনীন, তবে তুই কি করবি তা আমি জানি! তাহলে এবার দাওয়াইটা - শপথ কর যে তুই প্রতিদিন অন্ততঃ একটা করে লবঙ্গ খাবি। তবে তোর মনের ঐ কালো জিনিসটা আমায় দিতে হবে!"

"কালো জিনিস?"

"আরে! তোর মনে যে কালো আত্নাটা - যেটা আজকে তোর সাথে আমার কথার প্রথম থেকেই আমার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি - ঐটে দিতে হবে..না হলে নড়তে পারবি না!"

এভাবে রাজার কাছে আস্তে আস্তে সব পরিস্কার হয় - রক্ত গরম হবার পরও তিনি নিশ্চুপ থাকেন। দরবেশই নীরবতা ভাঙ্গেন -

"তোর কলজেটাই চাইতাম কিন্তু সেটা তোদের মত নীচদের জন্মগতভাবে অনুপস্থিত! কেন আয়নায় দেখিসনি কখনও?"

শুনে রাজার প্রচন্ড রাগ হয়! আর থাকতে পারেন না তিনি! একটা বড়সড় পাথর তুলে নিয়ে মারলেন ওর দিকে। পাথরটা ওর বুকে বেকায়দায় লেগে মুখ দিয়ে রক্তের ধারা বইয়ে দিল! যে বুকে আর মুখে-মুখে এত কথা - দুটোই রাজা চিরতরে স্তব্ধ করে দিলেন একেবারে এক ঢিলে! দেখতে দেখতে অনেক লোকজন জড় হলো!
একথা সেকথায় সবাই কি বুঝল, রাজাকে দে পিটুনি! গনধোলাই হলে, তাকিয়ে দেখেন দরবেশের দেহ উধাও! রাজা উঠেই দিলেন চোঁচা-দৌড়! কিন্তু পথিমধ্যে পা হড়কে...

তারপরদিন রাজা বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তবে সে রাজা এ রাজার অনেক তফাত! শরীর আর্ধেক হয়ে গেছে ভুগে, ভোগানিতে বড্ড দূর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি, অনেক কষ্টে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান! একি! টানা ছ'দিন গোসল না করে রঙটা অনেক খোলতাই আর কালচে হয়েছে সন্দেহ নেই! আর জামাকাপড়ের যা ছিরি, তাকে ছিরি না বলে ছেঁড়াছিঁড়ি বলাই ভাল! সারা গায়ে ব্যথা আর কেটে ছড়ে যাওয়া মারের দাগ - একেবারে দগদগে! লম্বায় আর্ধেক হয়েছেন!

আর রাজার মনে পড়ে গেলো তার রাজ্যের সবাই লম্বা- তাদের মধ্যে হাঁটুর সমান হয়ে বেঁটের মত তাকে এখন হাঁটতে হবে।
সবশেষে বুকের মাঝামাঝিতে দেখেন যে জিনিসটা থাকে সবার - সেটা নেই! তাহলে কি...

তাড়াতাড়ি জামা নামিয়ে ফেলেন তিনি! তারপর রাজা হিসাব কষেন--
ঘড়িতে ভোর পাঁচটা - সবাই ঘুমিয়ে, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে তার এই নিস্কর্মা অথচ সুন্দর চেহারার লোকের দেশে 'পাগল' ছাড়া অন্য কোন পরিনতি যে তার নেই, বুঝতে দেরী হয় না তার!

সবার ঘুম ভাঙ্গলে যা হবার তাই হয়, দরবেশের কথা ফলে যায় - আর হ্যাঁ! শেষবার তুমি ভেবেছ কিন্তু ঠিক! কিছুই না, একটু ইতরবিশেষ! শুধু 'পাগলা' নাম কি আর (যুৎ)সই হয় - ও নামে তো আজ আমরা সবাইকে মাথার পেছনে আদর করে ডাকি - তাই যারা তাকে একটু বেশীই ভালবাসত, তারা তাকে আদর করে মাথার সামনেই 'পাগলা বাবা' নাম-এ ডাকা শুরু করল - ওদের দেশে জ্ঞানীদের এভাবে ডাকার রীতি!

আর যে রাজ্যের প্রজাদের কথা বলছি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দুনিয়ার সেরা বলে দাবী করতো - তাই "নতুন" রাজাকে নিয়ে বন্দনাগীতি রচনা করা সময়ের ব্যাপার ছিল! আমার দৃষ্টিতে গানটাকে একেবারে সাধারনমানের 'হ য ব র ল' মনে হলে কি হবে, ওরা তো রোজ সকালে তোপধ্বনি সহকারে - এ 'জাতীয় সঙ্গীত' বাজিয়ে আমার কানের পোকা বার করেই ক্ষান্ত হল না, একেবারে সূদূরপারের দেশ - যেখানে প্রতিভা নেই, অথচ গানকে পন্য আর (ষ্টেন)গান বানিয়ে ব্যবসার কারিগরী জারিজুরি চলে- সেখানে একেবারে "টপ চার্টে" নাকি "চার্টের টপে" চলে গেল! আর যেটা ঘটেছে - সেটা ভাবতেই কান এখনই আমার লালে-লাল হয়ে উঠছে, কিছুই না এ দেশের 'জাতীয় সঙ্গীত'ই আজ দুনিয়ার সব দেশের সর্বসম্মতিতে সব ভাষায় অনুদিত হয়ে সার্বজনীন 'জাতীয় সঙ্গীত'এ পরিনত হয়েছে!
আর যে (অ)বিখ্যাত গান নিয়ে এত মাতামাতি - স্হানস্বল্পতার জন্য এখানে প্রথম চার কলি উদ্ধৃত করলাম -

"কে গো 'পাগলা বাবা' এলে যে
এই যে মোদের ভুবনে,
নতুন নামে ডাকব (রাজাকে) আবার ,
মোরা জানি, মন জানে"!?!........









রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯

অসীম দূরদর্শী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী



একটি ইংরেজী দৈনিকের অভিজ্ঞ এবং প্রধান সাংবাদিক সাইরাস তার গাড়ী থামালো বুড়ো হারুন সাহেবের গ্রাম্য খামার বাড়ীর সামনে। কিন্তু গাড়ী থেকে নামার পর বেশ কিছুটা অবাকই হল বলা যায়। সে চরম প্রতিদ্বন্দীতাপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিযোগীতার যুগে কিছু লোকের ভীড় না হলেও গুটিকতক ছোটখাট বাংলা দৈনিক অথবা ম্যাগাজিন অথবা বড়জোর একটা বাঙালী ফোরাম ওয়েবসাইটের সাংবাদিককে আশা করেছিল। আশা করেছিল বললে ভুল হবে - টিপিক্যাল সাংবাদিক গোছের সে নয়, বরং সাংবাদিকদের সার্কেলে - তার মাথার পিছনে "অসামাজিক" বলে তার একটা দূর্নাম আছে! তারপরও হালকা শিস্ দিতে দিতে টিপিক্যাল প্রফেসনাল সাংবাদিকের মত তার পত্রিকার সম্পাদক তাকে যে "মিশন ইম্পসিবল" দিয়েছেন, তাতে সে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এবং উৎসাহকে ঢেলে দিল।

পুরনো বাড়ীখানার দিকে তাকল সাংবাদিক সাইরাস। বাড়ীটি শান্ত - নিস্তব্ধ - শান্তিপূর্ণ। সামনের বাগানে তার অপছন্দের কিন্তু মনের গহীনে সে স্বীকার করবে যে, বাড়ীর মালিকের লাগান দৃষ্টিনন্দন নয় অথচ পুষ্টিগুনে ভরপুর এমন শীতের সবজী যেমন - মূলা, মটর-শূঁটি, গাজর, ওল-কপি আর দূরে বাদাম মানে জাম্বুরা, বেল এসব গছের দৃশ্যে - তার দু'চোখ সবুজ দেখে - অনেকদিন পর জুড়িয়ে গেল। নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে সে উপরে উঠতে লাগল।
সাংবাদিককে দেখে হারুন সাহেব কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। বললেন -

--কাকে চাইছেন?

--জী, আমি সাইরাস। দেশের সবচেয়ে বড় ইংরেজী দৈনিকের প্রধান সাংবাদিক।

--বাবা তুমি কোন সংবাদপত্রের কথা বলছ?

সাইরাস সাংবাদপত্রের নামটা বলে। পরিস্কার বুঝতে পারে, বুড়ো কোনদিন ইংরেজী সাংবাদপত্র দূরে থাক,গোটা দুনিয়ার সংবাদের ব্যাপারে উদাসীন এবং স্বভাবতঃই বুড়োর নাম তার কাছে অজানা। তবুও সে মোটেই বিব্রত না হয়ে বলে-

--আমাদের পত্রিকা অফিসে কে বা কারা ফোন করে জানিয়েছে যে আপনাদের একমাত্র সন্তান মেধা নাকি অত্যন্ত মেধাবী - স্কুল-বিতর্ক এবং দাবায় সে দেশের জুনিয়র চ্যাম্পিয়নই নয়, বাঁশীতে সে দেশের জুনিয়র ও বড়দের প্রতিযোগীতায় দেশে-বিদেশে অনেক বিরল সম্মান বয়ে এনেছে। এমন প্রতিভাধর মেধাবী এদেশের ইতিহাসে বিরল - তবে আমাদের বিখ্যাত সাংবাদপত্রের এ নিউজ আইটেমটিতে যে বিষয়ে কনসার্ন তা হল...

এতটুকু বলে সাইরাস একটু দম্ নেয়। প্রায় দশ-বারো ঘন্টার জার্নিতে দেশের প্রত্যন্ত অন্ঞ্চলে এসে এমন বিশাল হাস্যকর বক্তৃতা এবং দীর্ঘ পঁচিশ বছর চাকরির পরও তার এ পজিশনে এসেও এতটা খাটুনি - দুটোই তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। এতে যে শারিরিক-মানসিক কষ্ট - এত বছর চাকরির পরও - শুধু সম্পাদক সাহেবের সাথেই নয় মায় অফিসর পিয়নের সাথেও তার যে দৈনন্দিন মিস-কমিউনিকেশন - কেউ যে তাকে বুঝল না , কিইবা পেয়েছে জীবনে সে - না সুখ , না শান্তি , না পরিবার , না সমাজ - শারিরিকের চেয়ে যে মানসিক যন্ত্র-না - তা অনেক বেশী প্রকট হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। সে মনস্থির করে ফ্যালে - আজই সে সম্পাদকের কাছে চিঠি পাঠাবে - পদত্যাগের চিঠি! না! কোন ভাবাবেগ বা মানসিক চাঞ্চল্য যেমন - "সহকর্মীদের সাথে ভুল-বোঝাবুঝি বশতঃ" বা "পুরুষ সহকর্মীদের মাঝেও তাকে আলাদাভাবে সব ভুলের জন্য একপাক্ষিকভাবে বলির পাঁঠা বানান" এমন ঠুনকো অথচ মোক্ষম ছুতা সে চিঠিতে পদত্যাগের কারন হিসেবে দেখাবে না! সে আজকালকার অতি উচ্চপদস্থ কর্পোরেট এক্সিকিউটিভদের স্বকপোলকল্পিত 'স্বেচ্ছায় আমোদ-প্রমোদ সম্ভোগের ছুটি'র জন্য - ফস্ করে লেখা কল্পিত "লিভ অব এ্যাবসেন্স" এর মত ফরমাল লেটারে দেয়া "পারিবারিক বা ব্যক্তিগত" কারনের মত মধুর ভুল - কারন হিসেবে দেখাবে! যদিও ঘটনাচক্রে, তার পরিবার থেকেও সে পরিবারহীন! তাই "ওস্তাদের মার শেষ রাতে"র মত ক্যারিয়ারের বা হয়তঃ জীবনের এই শেষ ছুটি নেয়াটা সে সবচেয়ে কূটনৈতিকভাবে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চায়!

মোটা মাইনাস পাওয়ারের চশমার ভিতর থেকে দুটো কৌতুহলী চোখে চোখ পড়ে সাইরাসের।

--জী বাবা, যা বলার তাড়াতাড়ি শেষ করুন, কারন আমাদের হাতে সময় খুবই কম। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই মেধাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা রওনা হচ্ছি তো, তাই!

কন্ঠটা যথাসম্ভব কাঁদো-কাঁদো - যেন শোকবার্তা পাঠ করছে এমনভাবে বলে-

--জী, আমি সেই ব্যাপারেই সংবাদসংগ্রহের জন্য এসেছি। "মেধা-বিকাশের জন্য কনসার্ট" - যা আমাদের বিশিষ্ট সংবাদপত্র আয়োজন করেছে - যাতে সংগীত পরিবেশন করেছেন - বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী কাঙালিনী (!) সোনাই বিবি - যদিও আমরা পাশের দেশের সঙ্গীতশিল্পী বালু সাগু যার নিক্ নেম বাল্লু সাল্লু - তাকে অল্পের জন্য মিস্ করেছি -যা আমাদের সামগ্রিক ইনডাসট্রির জন্য বিশাল ক্ষতি আর সবচেয়ে বড় কথা হল - যাতে আরো অনেক বেশী টাকা আসত - তবে এতকিছুর পরও কনসার্ট শতভাগ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে! কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে
কনসার্ট থেকে আশানুরূপ টাকা ওঠেনি! তাই সম্পাদক সাহেব বললেন যে আবার বাল্লু সাল্লুর কনসার্ট হবে, আমাকে মেধার ব্যাপারে একটা রিপোর্ট বানাতে এখানে পাঠালেন।

--ও...!আচ্ছা...!আচ্ছা...!...কিন্তু সময় যে বড়ই কম! আমার মা মেধার চিকিৎসার জন্য এ মূহূর্তে না হলেও আজকের মধ্যে বেশ কিছু টাকা চাই। টাকার ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন?

--ওহ্ হো হো!...আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে আমাদের পত্রিকার 'সাহায্যের আবেদন' বিজ্ঞাপনেই তো ছিল যে মেধার মাথার সমস্যা! না মানে...ব্রেন টিউমার হয়েছে, তাই না?

অর্থনৈতিক ব্যাপারটা নিরর্থক টেনে না নিয়ে আসার জন্য হারুন সাহেবের নির্দোষ বাউন্সার থেকে সাইরাসের ব্যর্থ (ক্রিকেটের ভাষায় যাকে বলে) ডাক্ মারা!

--জী...হ্যাঁ! কিন্তু কোন টাকা কি সঙ্গে করে এনেছেন?

--আংকেল, আপনি একদম ভাববেন না, টাকা তো ক্যাশে আনা যেত না, তাই বিজ্ঞাপনে দেয়া ব্যাংকের একাউন্টে টাকা এতক্ষনে নিশ্চয়ই পৌছে গ্যাছে। টাকা কি তুলেছেন?

--দূর ছাই! পেলে কি আর এতবার জিজ্ঞেস করতাম তোমাকে? আমি আগেই এসব আন্দাজ করতে পেরেছিলাম, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়া এ আর কি হতে পারে? ঐ ব্যাংকের এ্যাকউন্ট তো ঢাকায় - আবার আমার এক আত্নীয়র নামে - সে টাকা আজ তো আর পাওয়া যাবে না! যাহোক...আমার আর কি ক্ষতি হবে বল? বললাম না আগেই আমি টের পেয়ে সবকিছু - মানে বাড়ি-ঘর, জমি-জাতি বন্ধক রেখে টাকা আর মেধাকে নিয়ে এখান থেকে চিরতরে চলে যাচ্ছি! আর তুমি নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপনে দেখনি যে - আমার মেয়েটি অটিষ্টিক!

--তাই নাকি?!

-যদিও আমার দৃষ্টিতে সে বুদ্ধিমতি,দূরদর্শী আর তোমাদের মত সবার দৃষ্টিতে আমার মেয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী! এখন পর্যন্ত আমার মেয়ে আমার চেহারা নয়- শুধু আমার কাজের প্রতিচ্ছবি হয়েছে, আমার দূরদর্শীতার মত গুন সে এ বয়সেই রপ্ত করতে পেরেছে-তাই আমি জানি সে আর কোনদিন এ'দেশে ফিরবে না তার ঐ গুনটি থাকার কারনে!
তবে জন্মগতভাবে সে এমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিল না, ছোটবেলায় ওর মার সাথে ও একবার এয়ারপোর্ট থেকে সিএনজীতে করে আসছিল, পথিমধ্যে কোন কারন ছাড়াই/এতে কারও কোনও হাত না থাকার পরও সিএনজীর সিলিন্ডারের বিস্ফোরনে ওর মা আর গাড়ীচালক ঘটনাস্থলেই মারা যায়!

--বলেন কি?

--হ্যাঁ...! আর আমার মেধা মা সৌভাগ্যবশতঃ ঈশ্বরের কৃপায় বেঁচে যায় ঠিকই কিন্তু তোমাদের মত সবার দৃষ্টিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে বেঁচে থেকে মরে থাকার মত অনেকটা!

সাইরাস বুঝতে পারে কথার প্রসঙ্গটা ক্রমশই অস্বস্তির দিকে যাচ্ছে! হারুন সাহেব বলতে থাকেন-

--যাহোক আমি বরাবরই এ বাণীটা জানি "একটা কলম সবসময়ই একটা তরবারির মত ভোঁতা"! তাই বলছিলাম কি যে, সংবাদপত্রের সামান্য এক পাতার অংশবিশেষে আমার মেধা মার সমস্ত মেধার ব্যাপকতা, গভীরতা এবং কোয়ালিটি - যে দিক দিয়েই দেখ - তা কুলোবে না! আর তোমার সঙ্গে এতক্ষন কথা কয়ে - তোমার সম্বন্ধে যা বুঝলাম - তা তুমি যে কেন তোমার বিশিষ্ট পত্রিকার প্রধান এবং সুযোগ্য রিপ্রেসেনটেটিভ তা বুঝতে আর বাকী নেই আমার! ( ভদ্রলোকের দম্ভোক্তি! )

সাইরাস বুঝতে পারে এরপর আর কোন কথা চলে না! আর কিইবা বলার আছে? সে ঘুরে দাঁড়ায়! ভাঙ্গা সিঁড়ি বেয়ে মোহগ্রস্তের মত নীচে নেমে এসে গাড়ীতে ফিরে যাবার জন্য উদ্যত হয়!


রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯

দুনিয়ার প্রথম ঘড়ি আবিষ্কারের গপ্পো...


ঘড়ি আবিষ্কারের আগে নিশ্চয়ই মানুষ অনেক কিছুই জানতো না। এই যেমন- কোন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে দেরী শেষ করে পরে নানান ছুতায় তার ওপরওয়ালার কাছে ঢাকবার মিথ্যা চেষ্টা। এ দুয়ের যে সম্পর্ক আছে তা জানতে গেলে এ গপ্পো আপনাকে পড়তে হবে -

তখন প্রথম ঘড়ি আবিষ্কারের সময় । সময়টা যে কখন তা ইতিহাসের পাতায় দেখে নিলেই চলবে।

এক ছিল সৎ লোক- যার নাম ছিল ফাহমি। মানুষ হিসেবে তাকে ভালই বলা যায়। দর্শন এবং ইতিহাসে তার ছিল পারদর্শিতা-যুক্তিবাদী এবং বাইরের বিষয়ে জ্ঞান ছিল বিস্তর। প্রচুর পড়াশুনা করত-কথা বলত কম - সবকিছুর পেছনে শুধু যুক্তি খুঁজে বেড়াত। সে আত্নমগ্ন, অনেকটা শিশুসুলভ ছিল। পরিচ্ছন্ন মাপা জীবন এবং প্রকৃতিও বড় শান্ত। প্রত্যেকদিনের জীবন ছিল নিয়মকানুনে বাঁধা।

ফাহমি পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষা নিয়ে ঠেলে ডিগ্রী নেয়ার পক্ষপাতী নয় কিন্তু ভবিষ্যত কাজের খাতিরে, আসলেই ও মাথা থেকে যেসব বিষয়কে পরমজ্ঞান বলে মনে করে সে সব বিষয়ে তার এতো জ্ঞান,তা এত গভীর যে, তা প্রায় অননুকরনীয়। সারাজীবন সাধনা আর পরিশ্রম বলে নিজেকে দুনিয়ার অধিকাংশ দরকারী বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ করে গড়ে তুলেছে সে । সাধারন খেয়ালের বশে কিংবা পাবলিককে তাক লাগানোর ছলে জ্ঞানকে সে সমৃদ্ধ করেনি।

তারপরও "দুনিয়ার কোন কিছুই খুঁতবিহীন নয়!" এরকম প্রাকৃতিক নিয়মে তার অজ্ঞানতার বহরটাও ব্যাপক এবং আশা-জাগানিয়া বটে! এই যেমন - সমসাময়িক রাজনীতির কোন খবরই সে রাখে না! শুধু রাজনৈতিকই নয়,ধর্মীয়,সামাজিক অধিকাংশ বিষয়েই তার অজ্ঞানতা আঁতকে উঠবার মত। তবে তার নিজের এই অজ্ঞানতা বিষয়ে তার যে জবাবদিহিতা বা যুক্তি তা অকাট্য-

-"আমাদের মাথাটা একটা খালি বাক্সের মত! যারা বুদ্ধিমান তারা শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সেখানে ভরিয়ে রাখে কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, তারা কোন অপ্রয়োজনীয় তথ্য ঢুকতে দেয় না আর ভুলক্রমে বাক্সে ঢুকে পড়লেও তা ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার ব্যবস্থা তাদের মাথায় থাকে! আর বোকার দলই যা-দরকার-নেই তা আশেপাশে মানে অন্যের মাথা থেকে কিংবা লাইব্রেরী বা বড়জোর মণিষীর বানী দিয়ে জোর করে ঠেসে সবসময় ভর্তি করে রাখে!"

সেই ফাহমি তার অফিসে একমাত্র লোক ছিল যে প্রতিদিন অফিস শুরু হবার অনেক আগে অফিসে গিয়ে বসে থাকত আর স্বভাবতই অন্য সহকর্মীদের হাস্যাস্পদ হত!

যাহোক,আমাদের গপ্পোর খাতিরে, সেই একই শহরে আরেক লোক ছিল-যার নাম ছিল হাজেম। মানুষ হিসেবে তাকে মোটেই ভালই বলা যায়না। যুক্তিহীন এবং বাইরের বিষয়ে ছিল অজ্ঞান। কোনদিন কোন পড়াশুনাও করেনি-ভয়ানক বেশী কথা বলে। অপরিমিত জীবন এবং প্রকৃতিও বড় অশান্ত ছিল। প্রত্যেকদিনের জীবন ছিল অনিয়মতান্ত্রিক। কিন্তু তার কেউ ছিল না। বাবা-মার মৃত্যুর পরও হাজেম কোন কাজকর্ম করত না, শুধু বসে বসে সব সম্পত্তি ভোগ করতো। মুখে তার ছিল মিষ্টি কথা। কিন্তু যখন সে বয়সে তরুণ হল, তখন একমাত্র ফাহমি ছাড়া তার সব বন্ধুরা তাকে ছেড়ে গেল। সে ছিল মূর্খ কিন্ত ধূর্ত,যদিও দুনিয়ার কোন খবরই সে রাখত না। সে যে খুব কাজের লোক ছিল তাও বলা যায় না। হাজেম জাঁকজমক পোষাক পরিচ্ছদে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালত কিন্ত দানের বেলায় সে হাত খোলার পাত্র নয়!অবশ্য যেদিন যা হাতে থাকে, সেদিনই তা শুধুমাত্র নিজের জন্য খরচ করে ফেলে,একটা পয়সাও হাতে রাখে না!কিন্ত এত কিছুর পরও ফাহমি আর হাজেমের ভারী ভাব!

স্বভাবতই দুনিয়ার প্রথম ঘড়ি আবিষ্কারের পর, দুনিয়ার অন্যতম প্রধান ধনী হাজেমই হল দুনিয়ার অন্যতম প্রথম ঘড়ি ব্যবহারকারী। ঘড়ি ব্যবহার করে সে যে সুফল কিংবা কুফল পেল তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে, সে গায়ে পড়ে ফাহমিকেও তখনকার দিনের প্রেক্ষাপটে একটা কমদামী ঘড়িকে "অনেক বেশী দামী ঘড়ি" বলে চালিয়ে দিল।

এদিকে ফাহমি ঘড়ি নিয়ে মনের সুখে বাসায় ফিরল। তার জীবদ্দশায় হয়তঃ কোনদিনই একটা ঘড়ি কেনার সামর্থ্য হত না তার,ভাবল সে! এদিকে ঘড়ির সময়ের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে তার দেহঘড়ির অভ্যাসে কিছু পরিবর্তন এলো! জীবনে যে সময় এত বেশী, তখন আবার সবে বিদ্যুতের ব্যবহার শুরু হয়েছে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ আবিস্কার হবার আগে সে সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে যেত। এখন এ দুই বিলাস-ব্যসন আসাতে তার দিনে ও রাতের জীবনে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেল। কিছুই না, শুধু সন্ধ্যায় হাজেম তাস আর নানারকম আড্ডাবাজির খেলার প্রচলন শুরু করল এবং এভাবে প্রতিদিন ফাহমির শুতে শুতে সামান্য কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা দেরী হতে লাগল।

আর এভাবেই প্রতিদিন সকালে সে অবসাদগ্রস্ত হয়ে দেরী করে উঠতে লাগল এবং স্বভাবতই এই (!) সামান্য কয়েক মিনিট দেরী করে অফিস যাওয়া শুরু করল। তার অনেক বছরের স্বভাবের এই আকস্মিক-আমূল পরিবর্তনে অফিসের সহকর্মী, বস্ থেকে শুরু করে এমনকি পিয়নও বেশ বিচলিত হল এবং স্বভাবতই তাকে নিজেরা সারা জীবনেও মানেনি এমন সব উপদেশ দিতে লাগল! সহকর্মীদের এ ব্যাপারে অতি উৎসাহী দেখে এবং তাদের কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে, কোম্পানীর মালিক শেষে একদিন আর থাকতে না পেরে ফাহমিকে ডেকে পাঠালো। কোম্পানীর মালিকের কাছে অবশ্য ফাহমি প্রথমদিন ছুতা দেখালো -

"স্যার, নতুন ঘড়ি উপহার পেয়েছি তো, যদিও সময়টা একদম ঠিক দেয় না, আর ঘড়িটা যাচ্ছে তাই রকমের ধীরে চলে, বুঝলেন!"

এরকম যা-ইচ্ছে-তাই মার্কা একটা অযৌক্তিক কথা বলে সেদিনকার মত সেখান থেকে সটকে পড়ে! এভাবেই দিন গড়াতে লাগলো। এদিকে ঘড়ির প্রযুক্তির উন্নতি হয়ে ডিজিটাল ঘড়ির প্রচলন হলো, যা কিনা মিলিসেকেন্ডও সঠিক সময় দেয়।

তারপরও কিন্তু, সেই যে আমাদের ভাল লোক গপ্পের ফাহমি বাস্তবের জীবনে আজও টিকে আছে! কেন তোমার চারপাশে তাকাও দেখবে, কিন্ত কাউকে আবার জোর-জবরদস্তি করে কিছু জিজ্ঞেস করতে যেও না যেন,হয় সে মিথ্যা বলবে যেটা আজকাল খুব নাকি চালু ব্যাপার, না হয় গপ্পের পরিবর্তিত,দ্বিতীয় জীবনের ফাহমির মতো- যে হয়ত আজকের তোমার আমার মত অতো সহজ সাবলীল অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে না,কিন্তু সে ফাহমিও গপ্পের বদৌলতে একটু আধটু সবে ছুতো দেখাতে শিখেছে, তেমনি ছুতো দেখিয়ে সে তোমার সামনে থেকে কেটে পড়বে!



রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯

'মুক্তিযুদ্ধ' নিয়ে এক চিমটে পলিটিকস্ বা শর্টফিল্ম এইসব...

যেন এইমূহূর্তে কিছু একটা করে ফেলব - এমন একটা আশংকায় সবাই বসেছি এখানে। আমি এই ইউনিটের প্রধান। আমাদের সঙ্গে আছেন বীরূভাই সংক্ষেপে - বীরূদা, কৈলেশ্বর দাদা, প্রিয়াংকা, মৃণাল ছাড়া আরো 'মুখহীন' ক'জন যারা আমাদের এই দলের স্বেচ্ছাসেবক এবং 'ধন্যবাদহীন' 'অন্তরালের কারিগর'রা - কাজটি সুনিপুনভাবে করার চেষ্টা করেন! আমাদের মধ্যে আমি আর বীরু ভাই ৭১' এ লড়েছি - মুক্তিযুদ্ধ! আর ওরা তো এই সেদিনই 'কথ্থক'এ এল।আমাদের মধ্যে বীরু ভাই একটু অন্যরকম। এই যাকে বলে একটু একগুঁয়ে স্বভাবের - অনেকটা আবেগপ্রবণও বটে!আমরা কে কখন কোথায় কিভাবে আছি - সব খবর ওর নেয়া চাই।

তো এটা আমাদের সপ্তম প্রযোজনা। চিত্রায়নের জন্য লোকেশন হিসেবে বেছে নিয়েছি সুখপুর গ্রামকে। সামনেই একটা ছোটখাট খালের মত - হয়তঃ তিতাসেরই একটা শাখা-টাখা হবে! দর্শক বলতে - সুখপুর গ্রামবাসী - স্বভাবতঃই যাদের মূল নাটকের চেয়ে নাটকের কলাকুশলী এবং অনেকটা গায়ে পড়ে কৌতুহল দেখানোর প্রবনতা বেশী! আজ যে অংশ চিত্রায়িত হবে তার জন্য মূল শূটিংস্পটে সরাসরি যাই চলুন:

একটা নৌকা - তার ওপর একটা খাটিয়া আড়াআড়িভাবে শোয়ান। খাটিয়াটা সবুজ। ওতে শুয়ে আছে গর্ভবতী প্রিয়াংকা। ও গর্ভবতী হওয়াতে ছবির কাহিনীর বরং কিছুটা সুবিধেই হয়েছে! আর বাকী ক'জন সব নৌকায়।

নৌকা চলেছে রূপপুরের দিকে। ছবিতে দেখাতে চাওয়া হয়েছে - একটি দল - যাদের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। তাদের একজনের স্ত্রী গর্ভবতী। সেজন্য তাকে একটা খাটিয়ায় শুইয়ে কাফনের কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! কোথায় গন্তব্য - জানেনা কেউই। প্রত্যেকের মুখে উৎকন্ঠা। এরসাথে আবার যোগ হয়েছে গুজব না কি সত্যি যে একটা কথা মুখে মুখে ফিরছে - পাশের গ্রাম রাজাকারদের ডিপো!

মাঝির নাম - বদর! বৃষ্টির দরকার ছিল না - তারপরও কিছুক্ষণ হল শুরু হয়েছে! বীরূভাইকে স্বভাবতঃই গম্ভীর দেখাচ্ছে। বাইরের গুমোট ভাবটা যেন ভর করেছে ওর চোখেমুখে! কিছু না বলে একটা 'আগরবাতি' (!) ধরাল! বুঝলাম, আস্তে আস্তে ও উত্তপ্ত হচ্ছে - ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা বাড়ছে ওর! কে যে কথা শুরু করব বুঝতে পারছি না - হঠাৎ ও বলল -
:৭১'এ সেই যুদ্ধটার কথা মনে আছে তোর?
:কোনটা?
:ফুলছড়ির ১১ নং সেক্টরের সেই যুদ্ধটা?
:হু! বেশ মনে আছে!
আবার চুপ! বুঝলাম, আরো ভাবছে ও! আর এদিকে আমি ভাবছি - দূর ছাই! আসল চিত্রনাট্য কখন পাঠ করব! প্রথমে বীরুভাইয়ের সংলাপ থাকলেও তখন থেকে নষ্টালজিয়ার নষ্টামিতে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও! 'অন্তরালের কারিগর' - কবি এই সেদিনও বীরুভাইকে বাদ দেবার কথা বলছিল! তবে ও ছাড়া অনেকেই জানে যে বীরুভাইই সেরা - কারন ওর কাছে কবি ছাড়া দলের অনেকের হাতেখড়ি - এখনও ওর কাছ থেকে শিখছি আমরা! এইয যাহ্! ধ্যান ভেঙ্গেছে গুরুর:
: নাও শুরু কর তোমরা!
:আরে আপনিই তো পথ বাতলাচ্ছেন না গুরু!
:এই প্রিয়াংকাকে নিয়ে হয়েছে যত সমস্যা! না পারি রাখতে - না পারি ফেলতে! সেদিনও ছোট্টটি ছিল - দেখা হলেই 'বীরূভাই' বলে গগনবিদারী ডাক দিত আর আমিও নির্বোধের মত অদ্ভুত এক মায়ায় ওর কাছে ছুটে যেতাম!
:তো সমস্যাটা কোথায়?
:সমস্যাতো ওখানেই! বারবার ফিরে যাওয়াটায় কাল হয়েছে! ঐ মায়াই শেষে দায়িত্বে বর্তাবে কে জানত! ওর বাবাটা গেল চল্লিশে - যক্ষায় - ধূমপান আর এ্যালকোহলের সৎ-স্ত্রীর সঙ্গে মিলে আগেই আসল স্ত্রীকে বিদেয় করেছে! অভিভাবকত্বের সংজ্ঞাটা হয়তঃ ওর কাছে উল্টো ছিল - সারাজীবন ভুগে ভুগে সবাইকে কৌশলে ভুগিয়ে সমস্ত সেবা আর মমতার শেষ রসটুকু নিংড়ে নিয়ে শেষে অসময়ে পরপারে গিয়ে একপাক্ষিকভাবে জয়ী হওয়া! তাই হয়তঃ কোন অস্পষ্ট ইঙ্গিতে মেয়েকে সঁপে দিয়ে গেল!
:হু!
:ছোড়্ দো! কুছ পরোয়া নেহি! খাদ্যের মজুদ কেমন বল তো? এ সপ্তাহ চলবে তো?
:মৃণাল?! কোথায় তুমি?
সে দিনই আবার বিশ্ব খাদ্য দিবস ছিল! আর ভাবছিলাম যে - স্বভাবতঃ সেদিন সবাই একটু বেশী বেশী খাচ্ছে -কারন 'বিশ্ব খাদ্য দিবসে'র মূলমন্ত্র হল - 'যারা বেশী খাচ্ছে তাদেরই বানানো পুরস্কারপ্রাপ্ত আবিস্কার 'কৃত্রিম দূর্ভিক্ষ'এর গিনিপিগ মানে এই আমাদের মত যারা অতটা খেতে পাই না - তাদের মধ্যে যারা ওদের চোখে 'হেরে গিয়ে' মরে যায় মানে ভাগ্যবান - তাদের জন্য 'প্রতীকি' ভুরিভোজ করে সারাদিন নাক ডাকিয়ে - ''নীরবতা" পালন করাই হচ্ছে খাদকশ্রেণীর নৈতিক দায়িত্ব! তাই সবচেয়ে কূটনৈতিকভাবে উপভোগ করে খাদ্যের ব্যাপারটা নিরর্থক টেনে না নিয়ে আসার জন্য বীরূভাইর বাউন্সার থেকে আমার ডাক্ মেরে (খাবারের) আম্পায়ার মানে মৃণালের দিকে দৃষ্টিআকর্ষণ করা! আগেই বলেছি - খেতে পাই না তাই মৃণালের কথাও একই:
:আজ দুপুরে উপোস দিতে হবে!
:খুউব হল! তবে এতদিন কি খেয়ে ছিলাম? আহামরি কিছু? ঐ রুটি যা খেতে পাই তা দিয়ে জুতো বানানো যায়!
ছোড়্ দো! কুছ পরোয়া নেহি! ও মাঝি! রূপপূর কতদূর?
: একদম্ চুপ মারি যান্! কিডা জানি আসতিছে সামনে থিকা!
: মৃণাল তোর স্টেনগানটা রেডী কর আর ঐ কুম্ভকর্ণগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে বল্ 'ইন্নালিল্লা' পড়ার সময় পাবেনা বোধ হয়!
:কেডা যায়?
:আগে কও তুমরা কেডা?
তখনও ইতস্ততঃ বোধ করছি। পরিচয় দিলে যদি কিছু ঘটে যায়! তবু সাহস করে মাঝি বলল
: মুক্তিযুদ্ধারা যাইতিছে গো!
ও নৌকায় এতক্ষনে সাড়া পড়ল-
: আল্লার নাম লইয়া যানগো সুনারা! আমরা যামু সুখপুরে!
: ছাছামিয়া দোয়া রাইখেন!
কিন্তু দোয়া রাখবার তখন সময় কই?

আপাততঃ এটুকুর চিত্রায়ন হয়। বাকীটুকু বিকেলে হবে। একটু গা এলিয়ে দিতে যাব এমন সময় আবার শুরু হল গুরুর গুড় গুড় ধ্বনি-
: আচ্ছা, বিকেলেই তো শেষ অংশের চিত্রায়ন হবে। তারপর ইউনিট প্যাকআপ - শুটিং বনধ! আমরা আবার যে যার জায়গায়!
:হুম্! তাই তো?
: একটা সিনেমা - মানে দর্শকের প্রশংসা আর হাততালি আদায় করার মত কিছু কথা জোড়াতালি দিয়ে মারা - এভাবেই তো সব শেষ, তাই না? কিন্তু এতে কতটুকু মুক্তিযুদ্ধকে আনতে পারছ ফ্রেমে? এরকম অসহায় পরিবার হয়তঃ ছিল সেসময় কিন্তু তাতে ট্রাজেডি কিংবা টুইষ্ট ফুটিয়ে তুলতে পারছ কই? তাই তোমার আগের বানানো অধিকাংশ ব্যবসাতে অসফল ছবিকে শুধু আমার এ্যাকটিং দিয়ে টেনে তোলার মত এ যাত্রায়ও ঠিক করেছি বিকেলে কিছু দেখাব?
:কিরকম?
:ও তুমি বুঝবে না! আসল এ্যাকটিং মুখের ভাষায় প্রকাশের বিদ্যা নয়! তারপরও বলি - অস্তিত্বের সংকট আবার জীবনবোধ এইসব আর কি!
আবার শুটিং শুরুর তোড়জোড় -একঘেঁয়ে! এবারের সিকোয়েন্সটা হবে এরকম - ভাবতে হবে কতগুলো গানবোট আসছে
এবং সংক্ষেপে মানে খুব বেশী না ক্ষেপে আমাদের অস্ত্রের ভাষায় জবাব দিতে হবে!
:রূপপূর পেরায়ই আসি গিচে!
:বীরুভাই! ও বীরুভাই! ঘুমুলেন নাকি!
:উঃ?!
:এখন আবার কি হল? উঠুন উঠুন! কখন যে ঐ সাচ্চা মোল্লার দল চলে আসবে - জানি না!
:ঠিকই! কেউ আসছে বোধহয়! আমি আওয়াজ পেয়েছি!
:জাগো বাহে! আমাগো মোল্লা ভাইগো বুলেট দিয়া খিলাইনোর সুময় হইচে!

সত্যিই গানবোট আসছে! একটার পর একটা! আমি নিথর! একটু শব্দ হলেই ওরা টের পাবে! হঠাৎই এরমধ্যে বীরুভাই এর গলার স্বরে পরিবর্তন - বাঁজখাই গলায় তার চিৎকার -
: সবাই একদম চুপ! আজরাঈল আসছে!
কিন্তু আমি ভাবছি অন্যকথা! সিকোয়েন্সটা তো আসলে এমন হবার কথা ছিল না! সব কেন যেন গোলমেলে ঠেকছে!
আমার আশ্চর্য হবার ভাবটা আর সবার মধ্যেও যেন সংক্রামিত হচ্ছে!
এরপর...আমরা যেন প্রথম আলো দেখলাম! কিন্তু এ আলোতে আমরা এ কি দেখলাম?! অতিমানবীয় কিছু! 'আসল এ্যাকটিং মুখের ভাষায় প্রকাশের বিদ্যা নয়'র মত বর্ণনাতীত অপ্রকাশ্য...হ্যাঁ...তবুও আমি যেটুকু বুঝছি সেটুকু লিখে যাচ্ছি...হায়েনার লাল চোখ...কিশোরীর বাঁশবনে ছোটাছুটি...ইয়াহিয়ার সেই ভয়ন্কর পোষ্টারের ফাঁকা ময়দানে আগুনে ঝলসে যাওয়া...আর ব্যাকগ্রাউন্ডে মানে সবকিছুর মূলে কিংবা গল্পের প্রথমে বলা সেই 'ধন্যবাদহীন - অন্তরালের কারিগর'এর মত - সেই 'অনেক শীত আর একটি বসন্ত' এর মত - সেই গনগনে টকটকে আমাদের সবার কাম্য - একটি লাল সূর্য! এ যেন পুরো মুক্তিযুদ্ধকে দেখলাম এ আলোতে!

চরিত্র পরিচিতি:


আমি:
পরিচিতির শুরুতেই এক চিমটি গসিপ বা স্পেকুলেষন - এ আমার রচনা নয়! মূল চিত্রনাট্যের খসড়াটা পাই একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে যে আজ অগোচরে হারিয়ে গেছে বা সেরকমই ভাবতে বা গুজব রটাতে আমি পছন্দ করি যাতে সিনেমা শুরুর সময় আমার নামটা দেখিয়ে (ইতি)-হাঁসে স্থান করে নেয়!
বীরু ওরফে 'বীরুভাই': সিনেমাতে আসা বলতে আমিই নিয়ে এসেছি তাকে! তবে তাকে প্রধান চরিত্র দেয়াটা - কিছুটা সিনেমার স্ক্রীপ্টের জন্য আর পুরোটাই তার মত ভারসাম্যহীনকে (!) ঠান্ডা রেখে কাজ হাসিল করার একটা পাঁয়তারা বা ষড়যণ্ত্র!


রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯

তারার হাঁস


“দি টাইমস্” পত্রিকার দক্ষ এবং প্রধান সংবাদদাতা রাফার্টি তার গাড়ী থামাল মিঃ আলসোপ-এর খামার বাড়ীর সামনে। কিন্তু সে গাড়ী থেকে নেমে অবাক হয়ে গেল।লোকের ভীড় দেখবার আশা করেছিল সে ।অথচ কোন জনপ্রানী দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কেউ নেই। ।পুরনো বাড়ীর দিকে তাকল সে। বাড়ীটি শান্ত - নিস্তব্ধ - শান্তিপূর্ণ। মুরগীর ঘর দেখা যাচ্ছে। খামার বাড়ীর আঙিনা কাদায় ভরা। নড়বড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। সাংবাদিককে দেখে মিঃ আলসোপ বারান্দায় বের হয়ে আসলেন। বললেন-

--কাকে চাইছেন?

--আমি ‘দি টাইমস’ এর রাফার্টি।

--রাফার্টি?

বুড়ো যে কাগজ পড়েন না এবং রাফার্টির নাম শোনেনি তা বোঝা গেল।।

--আমাদের পত্রিকাতে কে বা কারা ফোন করে বলেছে যে এখানে একটা প্লেন ভেঙে পড়েছে।আমি তাই সংবাদ সংগ্রহের জন্য এসেছি।

--কই,না…তো!

রাফার্টি বুঝতে পারল মিঃ আলসোপ খুবই ধীর গতিতে চিন্তা করেন। ক্যাচ্ করে দরজা খুলে গেল আর চটপটে মিসেস আলসোপ বেরিয়ে এলেন। রাফার্টি তাকে একই প্রশ্ন আরেকবার করল আর তিনিও একইভাবে বললেন-

--কই,না…তো!

রাফার্টি ঘুরে দাঁড়িয়ে ফিরে যাবার জন্য তৈরী হল।

--যত্তোসব, উড়ো খবর, অথচ ফোনের কলার খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবেই বলেছিল যে একটা জ্বলন্ত প্লেন, যার পিছন দিক দিয়ে নাকি আগুন বেরিয়ে আসছিল, তা এই মাঠে এসে পড়েছে।

মিসেস আলসোপকে একটু বিচলিত হতে দেখা গেল।

--ওহ্..হো..হো! ঠিকই তো ! আজ একটা ডানাবিহীন বিশাল বেলুন নিজের থেকেই উড়ে উড়ে মাঠে নেমে এসেছিল। ওখানা তো গুদামঘরের কাছে পড়ে রয়েছে দেখলাম। ওখানা যাদের তারা হাতুড়ি দিয়ে লোহা-লক্কড় বাঁকাতে পারে।

--হুম্!এটাতো অন্ততঃ একটা ছাপানোর মত সংবাদ বলেই মনে হচ্ছে!

মনে মনে বলে রাফার্টি। হয়তঃ রাফার্টির মনের কথাটি বুঝতে পেরেই মিসেস আলসোপ আরও বললেন-

--আপনি চাইলে ওটাকে দেখতে পারেন!

কথা না বাড়িয়ে রাফার্টি আর মিঃ আলসোপ কাদার উপরে ফেলা তক্তার উপর দিয়ে চললেন।

-- আলসোপ দম্পতির মত বোকা আর অদ্ভুত দম্পতি সারাজীবনেও কর্মসূত্রে দেখিনি।

ভাবছিল রাফার্টি আর ভাবতে গিয়েই তার একখানা পা পিছলে পড়বি পড় একেবারে কাদার মধ্যে গিয়ে পড়ল। তারপরও এভাবেই ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখে জিনিসটা বিরাট আকারের ‘প্লাস্টিক’এর বেলুনের মত। বেলুনের মাথার দিকটা গোল আর তলার দিকটা চ্যাপ্টা।

--মহাকাশযান সম্র্পকে কোন উন্মত্ত কল্পনার ফসল।

ভাবল রাফার্টি আর মনের চোখে দিব্য দৃষ্টিতে নিজের পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ছাপা হেডলাইনটা--

--চাঁদে প্রমোদভ্রমনের নামে অজপাড়াগাঁয়ের এক কৃষকের রকেট-চালিত মহাকাশযান নির্মাণ।

ব্যাপারটা মিঃ আলসোপের দৃষ্টি আকর্ষন করাতে তিনি বললেন-

--ওতে করে আমার কয়েকজন বন্ধু এসেছে।

তার কথায় পাত্তা না দিয়ে যেই না একটু এগিয়েছে অমনি রাফার্টি চীৎকার দিয়ে উঠে পা ঘসতে লাগল। মিঃ আলসোপ বললেন-

--বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে রাখবার জন্যই হয়তঃবা বেলুনকে ঘিরে একটা অদৃশ্য দেয়াল দেয়া আছে। কি বুঝলেন?

তার কথায় উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল-

--আপনার বন্ধুরা কোথায়?

--তারা বাড়ীর ভেতরে। আপনি চাইলে তাদেরকেও দেখতে পারেন!ছ’বছর আগে তারা এখানে প্রথম এসেছিল।মুরগীর ডিম চাঁদে চাষ করতে চায় তাই ওদের চাষের জন্য আমি একটা বাক্স বানিয়ে দিয়েছি।

ঘরে গিয়ে রাফার্টি দেখল এক পুরুষ আর এক নারীর মুখমুখি বসে আছেন মিসেস আলসোপ। তাদের দেহের শুঁড়গুলো আন্দোলিত হচ্ছে এদিক-উদিকে। ভাবলেসহীন মুখে বিশাল দুটি চোখ দেখেও মনে হচ্ছিল ওরা মুখোস পড়েছে নয়ত ওদের মুখখানা কেউ এঁকে দিয়েছে। বিস্ফারিত নেত্রে রাফার্টি বাকশক্তিহীন হয়ে পড়ল। তারপরও সে বিড় বিড় করে মনকে প্রবোধ দিল-

--এসব লোক ঠকাবার কৌশলে তুমি বিভ্রান্ত হয়ো না।তোমার ভিতরকার সাংবাদিক সত্তা যাতে সদাসতর্ক থাকে।
কাঁপা কাঁপা গলাকে লুকিয়ে বলল-

--নাম কি ওদের?

--ওরা নাম বলে না,শুধু মনের মধ্যে ছবি বানায়। আর ওদের শুঁড় দিয়ে যখন কারো দিকে লক্ষ্য করে তাক করে তখন ওরা যা চিন্তা করে তাই ঐ লোকটির মাথায় সঞ্চারিত হয়!

--কোথা থেকে এল ওরা?

--একবার জিজ্ঞেস করে দেখি।

বলে মিসেস আলসোপ প্রশ্নটি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির শুঁড় রাফার্টির কপালের মাঝে জায়গাটা লক্ষ্য করে তাক করল। হঠাৎ রাফার্টির মনে হল, তার রাবারের মত মনে হওয়া মাথাটাকে যেন কেউ বাঁকিয়ে,আঘাত করে নতুন রূপ দিচ্ছে। মনে হল যেন সীমাহীন নক্ষত্র , গ্রহ আর উল্কাপিন্ডের মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে এসে পড়ল এক অতি উজ্জল তারকার জগতে। এরপর, ছবি অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে উত্তেজিতভাবে বলল-

--এ কোন ধাপ্পা নয়! এরা সত্যিই গ্রহান্তরের জীব! পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রত্যক্ষ এবং সংগ্রহ করলাম আমি! কিন্ত আপনাদের ফোনটা কোথায়?

--ফোন তো নেই!ফোনের আর দরকারই বা কি!কারন কয়েক সেকেন্ড পরই তো ওরা চলে যাবে!

রাফার্টি বুঝতে পারল না সে কি বলবে কিংবা করবে।অবশ্য তার মাথা বলছে-

--এই সংবাদ পরিবেশন করতে পারলে তুমি তো খ্যাতির চূড়ায় পৌছে যাবে হে!এক্ষুনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়!

রাফার্টি খুব জোরে বলল-
--একখানা ক্যামেরাও কি আপনাদের নেই?

--নিশ্চয়ই আছে!তবে খুঁজতে হবে!

--তাহলে খুঁজুন আর মরুন কিংবা খুঁজতে খুঁজতে মরুন!

মিঃ আলসোপ অনিচ্ছাসত্তেও গরু খোঁজার মতই ক্যামেরার খোঁজে পাশের ঘরে গেলেন এবং কিছুক্ষন যেতে না যেতেই ব্যাজার মুখে বেরিয়ে এসে বললেন-

--অত্যন্ত দুঃখের এবং অনুতাপের বিষয় হল ক্যামেরায় ফিল্ম ভরা নেই,তাই ছবি তোলা যাবে না!

এদিকে রাফার্টির কিছু বুঝে উঠার আগেই গ্রহান্তরের জীবদুটো একই সঙ্গে জোনাকীর মত রাফার্টির বিস্ফারিত চোখের সামনে বেলুনে চড়ে উড়ে গেল!

--এইইযযা!পাখি যে উড়ে গেলো!

মিঃ এবং মিসেস আলসোপের একই সঙ্গে ব্যঙ্গ-উচ্চারণ! পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালের সবচেয়ে বড় ঘটনা শূন্যপথে কর্পূরের মত উবে গেল!কতটুকু আর তথ্য আছে তার হাতে?যে পুরুষটি লোহা বাঁকায় সে নিশ্চয়ই কর্মকার! পৃথিবী থেকে ডিম নিয়েছে তারা! রাফার্টির হতবুদ্ধি ভাবটা কেটে গেল।মাথাটা কিছুটা পরিস্কার হল।আছে…আছে…হয়ত এখনও বিশ্বাস করবার মত প্রমাণ রয়েছে!

--গ্রহান্তরের জীবদুটো কি ডিমের বদলে আপনাকে কিছু দিয়েছে?

--ছ’বছর আগে ওরা ওদের সাথে যে ডিমগুলো এনেছিল তাই আমাদের দিয়েছিল। ঐ তারার মত ডিমগুলো থেকে যখন বাচ্চা বেরুল তখন ঠাট্টা করে নাম দিয়েছিলাম ‘তারার হাঁস’। যে বুড়ী মুরগীটা ডিমে তা দিয়েছিল ডিমের ছুঁচাল দিকগুলো তাকে তা দেয়ার সময় বড় কষ্ট দিয়েছিল! তারার হাঁসগুলো চোখে দেখার চেয়ে চেখে দেখা ঢের মজা এবং সুস্বাদু ছিল!বড়দিনের সময় রোষ্ট করে খেয়েছি!মুখে এখনো স্বোয়াদ লেগে আছে!

--আর!তাদের কন্কাল?ওগুলোও কি তাহলে….?

--নান্…না! ছি! কি যা তা বলছেন! সে হাড়গুলি আমাদের কুকুরটাকে দিয়েছিলাম! তাও পাঁচ বছর আগের কথা! চার বছর আগে কুকুরটা ঐ গ্রহান্তরের জীবদুটোর মত এখান থেকে সটকেছে!

স্বপ্নাছ্ছন্নের মত রাফার্টি তার টুপিটা তুলল। নিতান্ত যাণ্ত্রিকভাবে বলল-

--ধন্যবাদ,মিঃ আলসোপ, ধন্যবাদ!

মেঘলা আকশের দিকে তাকল রাফার্টি। গ্রহান্তরের জীবদুটো এতক্ষনে মহাকাশযানে করে চলে গিয়েছে বহু দূরে।
কিন্তু তাদের পৃথিবীতে আগমনের কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই তার কাছে! রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন মিঃ আলসোপ। তিনি জামার আস্তিন দিয়ে একটা বক্স ক্যামেরার উপরে জমে থাকা ধুলো ঝাড়ছিলেন! রাফার্টির দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে তিনি বললেন-

--মিঃ রাফার্টি!অবশেষে হতভাগা ক্যামেরাকে খুঁজে পেয়েছি!



মূল: দ্য ষ্টার ডাক্স - বিল ব্রাউন


অনুবাদ : রাশিদুল ইসলাম

রাশিদুল ইসলাম © ২০০৯